মরিচঝাঁপির হিন্দুু গণহত্যা :
১৯৭১ সালের যুদ্ধে, মুসলমানদের তাড়া খেয়ে বাংলাদেশ থেকে কয়েক লক্ষ হিন্দু, উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে ঢুকে পড়লে, ভারত সরকার তাদেরকে নিয়ে গিয়ে রাখে দণ্ডকারণ্যে। সেখানে তারা মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ, ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে সিপিএম এর সমর মুখার্জি, মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের রাম চ্যাটার্জি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ দণ্ডকারণ্যে গিয়ে উদ্বাস্তুদের নেতা সতীশ মণ্ডলের সাথে দেখা ক'রে, প্রকাশ্য জনসভায়, তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার সর্বস্ব হারানো উদ্বাস্তু হিন্দু দণ্ডকারণ্য ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে এবং এর মধ্যে ৩২ হাজার উদ্বাস্তু হিন্দু, সুন্দরবনের মরিচ ঝাঁপি নামক দ্বীপের মতো একটি জায়গায় আশ্রয় নেয়। কলোনীর নাম রাখা হয় নেতাজী নগর। কিন্তু জ্যোতি বসুর সরকার হঠাৎ মত পরিবর্তন করে, যেভাবেই হোক উদ্বাস্তুদের মরিচ ঝাঁপি থেকে উৎখাত করতে হবে। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা ও অর্থনৈতিক অবরোধ। বন্ধ করে দেওয়া হয় জল ও খাদ্য সরবরাহ।
সেদিনগুলোর ঘটনা স্মৃতিচারণ করে পুলিশ ও কমিউনিস্ট হায়েনাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসাদের একজন নারায়ণ মন্ডল উল্লেখ করেন -
"সেদিন ৩০ থেকে ৩৫ টি লঞ্চ সহকারে পুলিশ পুরো দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে। কুমিরমারি থেকে খাবার জল আনতে যাবো, সেই পরিস্থিতিও ছিল না। আমাদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলার জন্য তারা উঠে-পরে লেগেছিল। অসহায়ভাবে খিদের জ্বালায় তাই আমরা নারকেলের পাতা ও ঘাস (যদু পালং) খেতে বাধ্য হই। বাচ্চাদের অনেকেই শুধু ডায়রিয়াতেই মারা যায়। পাশের কুমিরমারি গ্রাম থেকে খাবার জল, ঔষুধ এবং আহার-সামগ্রী যোগানের জন্য অবরোধের ১০ম দিনে আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। নারীদের দেখে অন্তত দয়া হবে এই আশায় আমরা একটা নৌকাতে ১৬ জন মহিলাকে পাঠায়। কিন্তু "ইন্দ্রজিৎ এমভি৭৯" নামের একটি লঞ্চ দ্রুত গতিতে নৌকাটির নিকট এগিয়ে আসে এবং নদীর মাঝপথে নৌকাটিকে বিধ্বস্ত করে। ১৪ জন নারীকে আমরা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করি। আর পরবর্তীতে বাকি দুজন কে বাগনান জঙ্গল থেকে উদ্ধার করি, যাদের উপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল।"
অবশেষে ১৯৭৯ সালের ৩১ জানুয়ারি, ১ হাজার পুলিশ ও সিপিএমের গুণ্ডাবাহিনী আক্রমন করে উদ্বাস্তুদের।
চারেদিকে অবরুদ্ধ, পালানোর কোনো পথ নেই। জলে কুমীর, ডাঙ্গায় পুলিশ। অর্থনৈতিক অবরোধে, অনাহারে ও অসুখে এবং সর্বশেষ পুলিশ ও সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর আক্রমনে মারা পড়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার হিন্দু, ৫/৭ হাজার এদিক ওদিক পালিয়ে কোনোরকমে প্রাণ রক্ষা করে।
এই ঘটনার শিকার একজন শরণার্থী মুকুন্দ মন্ডল স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন -
"দুপুর ৪টে নাগাদ পুলিশরা আমাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরা সে সময় একটা নৌকাতে করে দ্বীপ ছেড়ে পাশের কুমিরমারি গ্রামে পালাতে চাইছিলাম। চারদিক প্রবল আতংক ভর করেছিলো। সে সময় আমার নাতনির বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে একটা গুলি তার গায়ে এসে লাগে এবং নৌকাতেই তার মৃত্যু হয়। আমাদের তার মৃত দেহ নদীর জলে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমরা এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম সেই সময়।"
হত্যার পর পুলিশ ও সিপিএমের দলীয় কর্মীরা মৃতদেহগুলোকে নদীতে ফেলে দেয়। আবার অনেকেরই নদী সাঁতরে পালাতে গিয়ে ডুবে মৃত্যু হয।
ঘটনার পঞ্চদশ দিনে কোলকাতা হাই কোর্ট মরিচঝাঁপি দ্বীপে খাবার জল, প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং ডাক্তারদের প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে। শেষতক অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পেরে না উঠে তৎকালীন রাজ্যের সিপিআই(এম) সরকার মে মাসের দিকে জোরপূর্বক দ্বীপটিকে খালি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের উক্ত দ্বীপে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পুলিশের সহায়তায় দলীয় ক্যাডাররা মে মাসের ১৬ তারিখ ৩০০ টি পরিবারের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
কেন্দ্রে তখন জনতা সরকার। দিল্লি থেকে জনতা পার্টির একটি সংসদীয় দল মরিচ ঝাঁপি আসে ঘটনার তদন্ত করতে, কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার, তাদেরকে মরিচ ঝাঁপিতে ঢুকতেই দেয় নি।
এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন। কেনো উদ্বাস্তুদেরকে পশ্চিমবঙ্গে আসতে বলা হলো ? আর কেনোই বা তাদেরকে আবার উৎখাত করার প্রয়োজন দেখা দিলো ? কারণ কি এটাই যে, উদ্বাস্তুরা ছিলো সবাই হিন্দু ? আর হিন্দুদেরকে মারলে সাম্প্রদায়িক তকমা পাওয়ার ভয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না ? উদ্বাস্তুরা মুসলমান হলে বামফ্রন্ট কি এদের গায়ে হাত দিতো ? নিশ্চয় না। এর পরিবর্তে মরিচ ঝঁপিতে মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে দিয়ে তাদেরকে রাজার হালে থাকার ব্যবস্থা করে দিতো। বাস্তবে হয়েছেও তাই। হিন্দুদের উৎখাত করার পরেই মরিচ ঝাঁপি ভরে গেছে মুসলমানে । আগে ছিলো বামফ্রন্টের, এখন সেখানে তৃণমূলের এক চেটিয়া ভোট। আসলে এই ঘটনা ঘটানোর কোনো কারণই ছিলো না। বামফ্রন্টের হিন্দুদের প্রতি দরদ না থাক, সামান্য মনুষ্যত্ববোধ থাকলেও কি তারা এইভাবে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করতে পারতো ? প্রকৃতপক্ষে সিপিএম ছিলো একটি খুনী সরকার। মানুষ খুন করা ছিলো তাদের নেশা। তাদের প্রতীক যেমন লাল রং, তেমনি লাল রক্তেও ছিলো তাদের নেশা এবং সেই রক্ত হতে হবে অবশ্যই হিন্দুদের। উদ্বাস্তুদের এই ঘটনার শুরু থেকে শেষ, বিস্তারিত পাওয়া যাবে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে।
জয় হিন্দ।
No comments:
Post a Comment