Friday, 22 May 2020

অবশেষে আর্য সমাজীরা স্বীকার করিল যে- শ্রীকৃষ্ণই তাহাদের পরম গতি


অবশেষে আর্য সমাজীরা স্বীকার করিল যে- শ্রীকৃষ্ণই তাহাদের পরম গতি :

শিরোনাম দেখে চমকে যাইয়েন না, আমার প্রবন্ধটা পড়তে থাকুন, শেষে গিয়ে বুঝতে পারবেন, কেনো আমি এমন কথা বললাম বা আর্য সমাজীরা কিভাবে শ্রীকৃষ্ণকে তাদের ঈশ্বর হিসেবে মেনে নিলো।

আর্য সমাজীরা এই কারণে সমালোচিত এবং বিখ্যাত যে- শ্রীকৃষ্ণকে তারা ঈশ্বর হিসেবে মানে না। তারা নিরাকার ব্রহ্মকে ঈশ্বর হিসেবে মানে, কিন্তু সেই নিরাকার ব্রহ্ম যে প্রয়োজনে পৃথিবীতে দেহধারণ করে আবির্ভূত হন, সেটা তারা স্বীকার করে না।

সনাতন ধর্মে সাকার এবং নিরাকার দুই ধরণের উপাসনার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়, এটা কেবল উচ্চমার্গের সাধকদের পক্ষেই সম্ভব; সেই জন্য সাধারণ মানুষদের জন্য সাকার উপাসনা এবং যার মাধ্যম হলো বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা। কারণ, দেব-দেবীর উপাসনা করেও যে শ্রীকৃষ্ণেরই উপাসনা করা হয় এবং ঈশ্বরকে পাওয়া যায়, সেটা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, গীতার ৯/২৩ ও ২৫ নং শ্লোকে

আর্য সমাজীরা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু তারা উচ্চমার্গের সাধক স্তরে না পৌঁছে কিভাবে নিরাকার ব্রহ্মে মন স্থির করে, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। ধরে নিলাম আর্য সমাজীদের সবাই খুবই উচ্চস্তরের সাধক, তাই তারা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করে, কিন্তু তারা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে এই নিরাকার ব্রহ্ম বিষয়টি বোঝাতে পারবে না; কারণ, এই বিষয়টি বোঝার জন্য একটি লেভেলের জ্ঞান থাকা আবশ্যক, সেটা সবার মধ্যে থাকে না, বাচ্চাদের মধ্যে থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। নিরাকার ব্রহ্মের জ্ঞানকে বলা যায় পিএইচডি লেভেলের জ্ঞান, এখন বলেন, এই পিএইচডি লেভেলের জ্ঞান কি প্রাইমারি, হাইস্কুল বা কলেজ লেভেলের শিক্ষার্থীরা বুঝবে, না তাদের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব ?

পি.এইচডি লেভেলের জ্ঞান সবাই অর্জন করতে পারে না, এটা লাখে দু চারজন অর্জন করতে পারে, আর বাকিরা সবাই সাধারণ মানুষ, এই সব সাধারণ মানুষের জন্যই সাকার উপাসনা।

এবার আসুন দেখা যাক, মনি বর্মনের যে ফটো এই প্রবন্ধের সাথে যুক্ত করে পোস্ট করেছি, সেটার বিশ্লেষণে-

মনি বর্মন, গীতার ৩/২১ নং শ্লোকের রেফারেন্স দিয়ে যা বলেছে, গীতা অনুযায়ী তার মূল ভাব ঠিকই আছে, কিন্তু সে যে শ্রেষ্ঠ বলতে কেবল আর্য সমাজীদেরকে এবং আর্য সমাজী মাত্রই বিদ্বান ব্যক্তিদেরকে বুঝিয়েছে, এটা তার নিজের ধারণা হতে পারে, বাস্তবতা ভিন্ন। আর্য মানে শ্রেষ্ঠ, সদ্বংশজাত; কিন্তু সেই আর্য, দয়ানন্দ সবস্বতীর অনুসারী আর্যরা নয়। দয়ানন্দ সরস্বতীর নিজের এবং তার অনুসারীদের মুখের যে ভাষা এবং যে জ্ঞান, তাতে তারা কিছুতেই শ্রেষ্ঠ অর্থে আর্য হতে পারে না। আর্য পদবী ধারণ করলেই যদি শ্রেষ্ঠ হওয়া যেতো, তাহলে বাঘা নামের কুকুর কখনো নিচামা অর্থাৎ হাড্ডিসার হতো না।

এরপর মনি বর্মন, গীতার ১৮/৫ নং শ্লোকের রেফারেন্স দিয়ে বলেছে- "যজ্ঞ, দান, তপস্যা ত্যাজ্য নহে, উহা করাই কর্ত্তব্য(যজ্ঞ, দান, তপস্যা বিদ্বান গনের চিত্তশুদ্ধিকর)"

গীতার এই শ্লোকটি হলো-

"যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যং কার্যমেব তৎ।
যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্।।"

-খেয়াল করে দেখুন এই শ্লোকের মধ্যে কিন্তু 'মনীষিণাম্' শব্দটি আছে, কিন্তু আর্য সমাজীরা যেহেতু নিজেদেরকে বিদ্বান মনে করে, সেহেতু এই শ্লোকের অনুবাদে মনীষী শব্দটি বাদ দিয়ে বিদ্বান শব্দটি ঢুকিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য শব্দ পরিবর্তন করে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার এই শিক্ষা অবশ্য আর্য সমাজীরা তাদের গুরু দয়ানন্দের কাছ থেকেই পেয়েছে। কারণ- দয়ানন্দ, মনু সংহিতার অনেক শ্লোকের অর্থ পরিবর্তন করে তার সংস্কারবিধি এবং সত্যার্থপ্রকাশে ঢুকিয়েছে এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা নিজের মতো করে দিয়েছে।

এরপর যজ্ঞ প্রসঙ্গে গীতার ৩/১১ নং শ্লোক, যেখানে বলা হয়েছে-

"এই যজ্ঞদ্বারা তোমরা দেবগণকে (ঘৃতাহুতি প্রদানে) সংবর্ধনা করো, সেই দেবগণ (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদের সুখী করুন। এই রূপ পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে।"

-এই শ্লোকের দ্বারা মনি বর্মন এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, গীতার নির্দেশ যেহেতু দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করা, সেহেতু আর্য সমাজীরা যজ্ঞ করে এবং তাই তারা গীতার নির্দেশ মোতাবেক সঠিক পথে আছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো- দেবতা মানেই পৌরাণিক চরিত্র, আর আর্য সমাজীরা পুরাণকে মানে না, তাহলে তাদের পৌরাণিক দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার প্রয়োজন কী ? আমরা যারা পুরাণ মানি, তারা দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করবো, কিন্তু আর্যরা কেনো ? যাকে পিতা বলে স্বীকারই করে না, তাকে পিতা বলে ডাকবে কেনো ?

যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট করে তাদের কাছ থেকে ফল লাভ করা অবশ্যই যায়, এটা পার্থিব এবং স্বর্গের সুখ দিতে পারে, কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে না। মোক্ষের জন্য শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া প্রয়োজন, আর দেবতাদের পূজা করলে যে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করা হয় এবং শ্রীকৃষ্ণে পূজা করলে যে শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায়, এটাই শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন গীতার ৯/২৩ ও ২৫ নং শ্লোকে, যেটা আগেও উল্লেখ করেছি।

এছাড়াও আমরা জানি, দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞ, তা দ্রব্যময় যজ্ঞ। কিন্তু গীতার ৪/৩৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, "দ্রব্যময় যজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ"। আর জ্ঞানযজ্ঞ হলো- গীতার পঠন পাঠন অধ্যয়ণ, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণেরই পূজা করা হয়, যেটা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার ১৮/৭০ নং শ্লোকে। এছাড়াও গীতার ১৮/৬৯ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"মানুষের মধ্যে গীতাশাস্ত্র ব্যাখ্যাকারীর চেয়ে আমার অধিক প্রিয় আর কেহ নাই এবং এই জগতে তাহার চেয়ে অধিক প্রিয় আমার আর কেহ হইবে না।"

সুতরাং এটা প্রমাণিত যে- গীতা অধ্যয়ন ছাড়াও, দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার চেয়ে, দেবতাদের পূজা করা ভালো। কারণ, এর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করা হয় এবং শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সুতরাং গীতা অনুযায়ীই, যারা দেবতাদের পূজা করে বা গীতা অধ্যয়ণ করে, তারা যজ্ঞকারী আর্য সমাজীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

এরপর মনি বর্মন বলেছে- গীতায় যেসব চরিত্র আছে, সেগুলো ভেদ বিদ্বান এবং মূর্খ। এখানে শ্রীকৃষ্ণ বিদ্বান অর্থাৎ উপদেশ দাতা এবং অর্জুন মূর্খ শ্রোতা।

এই মনি বর্মন যদি মূর্খের সংজ্ঞা জানতো, তাহলে আর এই কথা বলতো না। মূর্খ সে নয়, যে কিছু জানে না; মূর্খ সে, যে কিছু জানতে বা শিখতে চায় না। যে মূর্খ, সে কখনো কোনো প্রশ্ন করে না। কিন্তু পুরো গীতা জুড়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে অসংখ্য প্রশ্ন করেছে, এটা কি অর্জুনের মূর্খতার পরিচয়। মূর্খ তো আর্য সমাজীরা যারা আসল এবং বাস্তব ব্যাপারগুলো বুঝতে চায় না।

গীতার ৭/১৬,১৭ নং শ্লোকে যে বলা হয়েছে- জ্ঞানী ভক্তই শ্রেষ্ঠ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, জ্ঞানী ভক্তই শ্রীকৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু এই জ্ঞানী ভক্ত তারাই, যারা গীতার পঠন পাঠন করে (গীতা, ১৮/৬৯), জ্ঞানী ভক্তরা আর্য সমাজীদের মতো দ্রব্যময় যজ্ঞ করে না, তারা জ্ঞানযজ্ঞ করে।

কমেন্টের একেবারে শেষে মনি বর্মন গীতার ৮/১৩ নং শ্লোকের রেফারেন্স দিয়ে বলেছে, ওম নাম জপ করলেই পরমগতি লাভ হয়। কিন্তু এই ওঁ জপ দ্বারা যে শ্রীকৃষ্ণকেই স্মরণ করা হয়, সেটা সম্ভবত আর্য সমাজীরা জানে না, জানলে অন্তত এই শ্লোকের রেফারেন্স দিতো না। নিচে দেখে নিন এই শ্লোকের অনুবাদ, তাহলেই বুঝতে পারবেন ওঁ দ্বারা আসলে কাকে বোঝায় বা কাকে স্মরণ করা হয়-

"সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার সংযত করিয়া, মনকে হৃদয়ে নিরুদ্ধ করিয়া, প্রাণকে ভ্রুযুগলের মধ্যে ধারণ করিয়া, আত্মসমাধিরূপ যোগে অবস্থিত হইয়া, ওঁ- এই ব্রহ্মাত্মক একাক্ষর উচ্চারণপূর্বক আমাকে স্মরণ করিতে করিতে যিনি দেহত্যাগ করিয়া প্রস্থান করেন, তিনি পরমাগতি প্রাপ্ত হন।"

খেয়াল করুন, এখানে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট বললেন, "ওঁ- উচ্চারণপূর্বক আমাকে স্মরণ করিতে করিতে যিনি দেহত্যাগ করেন, তিনি পরমাগতি প্রাপ্ত হন।" তার মানে ওঁ দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকেই স্মরণ করা হয় এবং তার মাধ্যমেই পরমগতি লাভ করা যায়। আর্য সমাজীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা এইভাবেই পরমগতি লাভ করে, এখন বলেন- আর্য সমাজীরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমব্রহ্ম হিসেবে মানে কি না বা শ্রীকৃষ্ণকেই পরমগতি মনে করে কি না, যে বিষয়টি আমি এই প্রবন্ধের শিরোনামে উল্লেখ করেছি।

আর্য সমাজীদের মতো আমার জ্ঞানের এত অহঙ্কার নেই, আর এটাও আমি মনে করি না যে কেউ আমার এই প্রবন্ধের জবাব দিতে পারবে না (যদি থাকে)। সে জন্য আমার এই প্রবন্ধের যুক্তিযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য আমি আর্য সমাজীদের মতো ৩ হাজার বা ৫ হাজার বছর সময় বেঁধে দিতে চাই না; যদি তারা পারে, তারা যেন এর জবাব দেয়। আবার যেন তারা রাজনৈতিক দলের মতো এই অজুহাত না দেয় যে মনি বর্মনের বক্তব্য তাদের সংগঠনের বক্তব্য নয়, ওটা মনি বর্মনের ব্যক্তিগত মন্তব্য, এই ধরণের স্টেটমেন্ট কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়। আমার অনুসারীরা যা ই বলুক, সেটা যেমন আামার দায়িত্ব, তেমনি আর্য নামধারী যে যা বলবে, তার সমস্ত দায়িত্ব আর্য সমাজের।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment