Friday, 8 May 2020

প্রসঙ্গ : হরিচাঁদ ও মতুয়াবাদ


‘মতুয়া’ শব্দটি আমি প্রথম দেখি সম্ভবত ২০১২ বা ১৩ সালে বাংলাদেশের জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে, যেখানে মতুয়াকে ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ করা হয়েছিলো। তখন শুধু আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে, মতুয়ারা হিন্দু ধর্মেরই একটি শাখা, যারা হিন্দুধর্মের বাইরে এসে আলাদা একটি পরিচয় চাইছে; তখন আমার মনে এই প্রশ্নও জেগেছিলো যে, মতুয়াবাদকে স্বীকৃতি দিলেই কি ওরা মুসলমানদের নির্যাতন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে, না ওরা নিজেদের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারবে ? বাস্তবতা বলে কোনোটাই পারবে না, এ প্রসঙ্গে তখন আমার এই কথাও মনে হয়েছিলো যে, তাহলে এই ন্যাকামীটার দরকার কী ?

মতুয়া সম্পর্কে আমি আরেকটু জানতে পারি, যখন আমি ২০১৬ সালের শুরুর দিকে যশোর মাগুরা এলাকায় কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে যাই। সেখানে একজন আমাকে মতুয়াদের সম্পর্কে যা যা জানায়, তা হলো-
মতুয়ারা তাদের গুরু হরিচাঁদকে মনে করে ঈশ্বরের সর্বশেষ পূর্ণ অবতার, এ প্রসঙ্গে তাদের যুক্তি হলো- ভগবান যখন রামচন্দ্র রূপে জন্মগ্রহন করেন, তখন তিনি সীতাকে ঠিকমতো কাছে পান নি, তার সাথে আনন্দ তথা তার কাছ থেকে যৌনসুখ সেভাবে পান নি, এরপর ভগবান যখন শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহন করেন তখনও তিনি রাধাকে পান নি, তারও পর ভগবান যখন চৈতন্য রূপে জন্মগ্রহন করেন তখনও তিনি কোনো ভোগ বিলাসে মত্ত হন নি, তার এই আক্ষেপ মেটাতে ভগবান হরিচাঁদ রূপে জন্মগ্রহন করেন এবং তার স্ত্রীর সাথে পূর্ণ আনন্দ ভোগ করে যান, এই জন্যই তিনি মতুয়াদের কাছে পূর্ণব্রহ্ম।

এর সাথে সে আরো বলে হরিনামে মাতোয়ারা বলেই তাদেরকে মতুয়া বলা হয়। এটা শুনে যে কারো মনে হবে, যেহেতু তারা হরিনাম করে, সেহেতু তারা কৃষ্ণভক্ত; কারণ, পৃথিবীতে ‘হরি’ বলতে শুধু ভগবান বা চুড়ান্ত অর্থে শুধু কৃষ্ণকেই বোঝায়। কিন্তু আমি যেহেতু হিন্দুধর্ম ও সমাজের উন্নতির জন্য লিখি এবং এ ব্যাপারে মুসলমানদের কটূক্তির যথাযোগ্য জবাব দিই, সেহেতু মুসলমানদের মতো মতুয়ারাও যেহেতু কৃষ্ণ ও হিন্দুদের সম্পর্কে যা তা মন্তব্য করে, সেহেতু আমার ফেসবুক বন্ধুরা সেই বাজে কমেন্টগুলোর স্ন্যাপশট আমার কাছে পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করতে থাকে আমি যেন সেগুলোর জবাব দিই, এরূপ বহু অনুরোধের পর শেষ পর্যন্ত যখন আমি মতুয়াদের সম্পর্কে লিখবো বলে সিদ্ধান্ত নিই এবং সেই ঘোষণা আমার টাইম লাইনে দিই, তখন আমার বন্ধুরা আমার কাছে মতুয়াদের মনোভাব সম্পর্কিত আরো যেসব তথ্য দিলো তাতে আমি যার পর নয় বিস্মিত, দেখলাম, মতুয়ারা কৃষ্ণকে তো মানেই না, এমনকি নতুন লিখা পুরাণের রেফারেন্সকে ভিত্তি করে কৃষ্ণ প্রসঙ্গে রাধাকে টেনে কৃষ্ণ সম্পর্কে যা ইচ্ছা তাই তারা বলে এবং কৃষ্ণকে অপমান করে; এর জবাব দেওয়ার জন্যই মতুয়াদের বিরুদ্ধে, আমার এই- ল্যাপটপ খুলে এমএস ওয়ার্ড নিয়ে বসা।

যা হোক, শুরুতেই মতুয়াবাদের প্রবর্তক হরিচাঁদের জীবনীর দিকে নজর দিই, হরিচাঁদের জীবনী সম্পর্কে উইকিপিডিয়া লিখেছে,
হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ অবিভক্ত বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার অন্তর্গত ওড়াকাঁন্দির পার্শ্ববর্তী সফলাডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মাতা-পিতার নাম অন্নপূর্ণা ও যশোমন্ত বৈরাগী। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে হয়নি, কিন্তু প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার করতেন। বৈষ্ণব বাড়িতে জন্ম হওয়ার কারনে শাস্ত্র আলোচনার মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করার সুযোগে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি।[১] তাঁর প্রচলিত সাধন পদ্ধতিকে বলা হতো মতুয়াবাদ। তাঁর দুই ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর ও উমাচরণ। গুরুচাদ পিতা হরিচাদের মৃত্যুর পর মতুয়া ধর্মের উন্নতিসাধন, শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন।[২] হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী নিয়ে কবি রসরাজ তারক চন্দ্র সরকার শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত নামক গ্রন্থটি রচনা করেন।[৩]হরিচাঁদ ঠাকুর কলি যুগের শেষ এবং শ্রীহরির পূর্ণ অবতার যা তার অনুসারিদের সকলে বিশ্বাস করেন। তাকে বলা হয় পতিতপাবন।
যা হোক, হরিনামে মাতোয়ারা বলেই তারা মতুয়া, এটা শুনে আমি যেমন ধোকা খেয়েছিলাম, এটা ভেবে যে, তারা বুঝি কৃষ্ণভক্ত, তেমনি মতুয়ারা তাদের মূল শ্লোগান,
“হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি নাম সার। প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার”
এটা প্রচার করেও, মতুয়ারা সমস্ত হিন্দুদের সাথে এক চরম প্রতারণা করে চলেছে; কারণ, হরি বলতে বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই বোঝায়, যেটা আগেও বলেছি, এর ফলে মতুয়াবাদ একটি ছদ্মবেশি মতবাদ, যা প্রাথমিকভাবে বোঝায় এক, কিন্তু ভেতরের রূপ আরেক।

‘হরি’ নাম অবলম্বন করলেও মতুয়ারা কৃষ্ণকে মানে না এবং তারা যে কৃষ্ণকে মানে না তার কারণ, তাদের একমাত্র কথিত ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ গ্রন্থে বলা আছে,
“কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই ।
বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই ।।"
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আমিই সাম, ঋক ও যজুর্বেদ। তাই যারা বেদকে মানে না তারা কৃষ্ণকেও মানে না, আর মতুয়াদেরকে এই শিক্ষা হরিচাঁদই দিয়ে গেছে।
মতুয়ারা যেহেতু বেদ মানে না, তাই তারা কৃষ্ণকেও মানে না, আর যারা কৃষ্ণকে মানে না তারা সনাতনী বা হিন্দু নয়। তাহলে মতুয়ারা প্রকৃতপক্ষে কী ?
হরিলীলামৃত গ্রন্থে দেখা যায়, বুদ্ধের কামনা পরিপূর্ণ করতেই হরিচাঁদের জন্ম । অর্থাৎ বুদ্ধের দর্শন পুনঃ প্রতিষ্ঠার সংকল্পেই তাঁর আবির্ভাব । এজন্য হরিলীলামৃতে বলা আছে-
“বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য ।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ। “
যেহেতু বুদ্ধের কামনা পরিপূর্ণ করার জন্যই হরিচাঁদের জন্ম, সেহেতু নিশ্চয়ই বলা যায় যে, মতুয়া দর্শন হলো বৌদ্ধ দর্শনের এক শাখা বা বিবর্ধিত রূপ। কিন্তু বৌদ্ধরা কি মতুয়াদের এই দাবীকে স্বীকার করে বা করবে ?
নিশ্চয় নয়।
তাহলে মতুয়াদের জায়গা কিন্তু বৌদ্ধদের কোলেও হয় নি বা হবে না। অন্যদিকে মতুয়ারা আবার নিজেদেরকে হিন্দু ভাবতেই পারে না, তাই তারা হিন্দু ধর্মের নানা বিষয় নিয়ে যা ইচ্ছে তাই ব’লে সমালোচনা করে। নেট-ফেসবুকে হিন্দু ধর্ম নিয়ে এদের সমালোচনা দেখলে মনে হবে, হিন্দু নামে ফেক আইডি খুলে কোনো মুসলমান হয় তো এসব কথা বার্তা বলছে।

যা হোক, নিজেদেরকে হিন্দু না ভাবলেও, হিন্দু ধর্মের থিয়োরি বা তত্ত্বকে কিভাবে মতুয়ারা নিজেদের মতবাদকে ব্যাখ্যা করতে ও প্রচার করতে ব্যবহার করছে, এবার সেগুলোই আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
মতুয়ারা বলে, হরিচাঁদ নাকি ঈশ্বরের শেষ অবতার এবং পূর্ণব্রহ্ম। এই অবতারের সিরিয়াল তারা করে এভাবে-
বিষ্ণু>কৃষ্ণ>বুদ্ধ>চৈতন্য>হরিচাঁদ। এ সম্পর্কিত একটি ফটো, এই পোস্টের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি, সেটা দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন। শুধু তাই নয় হরিচাঁদকে তারা বলে পূর্ণব্রহ্ম। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- পূর্ণব্রহ্ম বা অবতার তত্ত্ব কোন ধর্মের থিয়োরি ? নিশ্চয় সনাতন বা হিন্দু ধর্মের। তাহলে যে মতুয়ারা নিজদেরকে হিন্দুই ভাবে না, তারা হিন্দুধর্মের থিয়োরিকে অবলম্বন করে তাদের মতবাদকে ব্যাখ্যা করেছে বা করছে কেনো ?

মুসলমানরা তাদের সর্বশক্তিমানকে- আল্লা বলে, ইহুদিরা জিহোবা, খ্রিষ্টানরা গড; আর আমরা হিন্দুরা সর্বশক্তিমান সত্ত্বাকে বলি ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। হিন্দুশাস্ত্র গীতায় বলা হয়েছে, যখন পৃথিবীতে ধর্ম স্থাপনের জন্য ঈশ্বরকে আসতে হয় তখন তিনি অবতার হিসেবে পৃথিবীতে আসেন, এই অবতারসমূহের মধ্যে- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম ছিলেন ঈশ্বরের আংশিক অবতার; আর শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন পূর্ণ অবতার; কারণ, তিনি ব্রহ্মের পূর্ণশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণব্রহ্ম বলা হয়, অন্য কাউকে নয়। শুধু তাই নয়, হিন্দুশাস্ত্রে একথাও বলা আছে যে, শ্রীকৃষ্ণের পর একমাত্র কল্কি ই অবতার হিসেবে আসবেন, অন্য কেউ নয়, তাহলে হরিচাঁদ নিজেকে অবতার বা পূর্ণব্রহ্ম বলে দাবী করার কে বা তার অনুসারীরাই বা তাকে কেনো অবতার বা পূর্ণব্রহ্ম হিসেবে প্রচার করছে ? সবচেয়ে বড় কথা হলো- যারা নিজেদেরকে সনাতনী বা হিন্দু ভাবে না, তারা তাদের মতবাদের প্রকাশ ও প্রচারে হিন্দুধর্মের থিয়োরি বা তত্ত্বকে ব্যবহার করবে কেনো ? আর যদি তারা তা ব্যবহার করতে বাধ্যই হয়, তাহলে তাদের পক্ষে হিন্দুধর্মকে গালিগালাজ করা কি শোভা পায় ? এই আচরণ কি নিজের মাকে বেশ্যা বলে গালি দেওয়ার সমান নয় ?

হরিচাঁদ যে নিজেকে পূর্ণব্রহ্ম বলে দাবী করেছে, দেখুন হরিলীলামৃতে তার প্রমান-
"পূর্ণ আমি হরিচাঁদ অপূর্ণের পিতা
সাধনা আমার কন্যা, আমি জন্মদাতা ।"
একদিকে হরিচাঁদ হিন্দুধর্মের থিয়োরিকে ব্যবহার করে নিজেকে অবতার বলছে, কৃষ্ণকে টেক্কা দেওয়ার জন্য নিজেকে পূর্ণব্রহ্ম বলছে, অন্যদিকে বলছে বেদ মানি না, তাই সে বলেছে,
‘বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই’
হরিচাঁদের এই বেদ না মানার একটা কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি। উপরে উইকিপিডিয়ার রেফারেন্সে হরিচাঁদের যে জীবনী তুলে দিয়েছি, খেয়াল করুন, সেখানে বলা আছে-
“তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে হয়নি, কিন্তু প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার করতেন।”
তার মানে হরিচাঁদ ছিলো নিরক্ষর, যাকে সহজ বাংলায় বলে মূর্খ, আর মূর্খ একজন ব্যক্তির পক্ষে বেদ কিভাবে পড়া সম্ভব বা বেদের বিধি বিধান তার পক্ষে কিভাবে জানা সম্ভব ? এজন্যই তার সহজ বিধান, বেদ বিধি মানি না। যে জ্ঞানী বা জানে, তার পক্ষেই সেই বিষয় মানা সম্ভব, যে জানেই না, তার পক্ষে সেটা কিভাবে মানা সম্ভব ?

উপরেই জেনেছেন, হরিনামে মাতোয়ারা বলেই তারা মতুয়া, আবার এটাও বলেছি বা সবাই জানেন যে, সারা বিশ্বব্যাপী ‘হরিনাম’ বলতে একমাত্র কৃষ্ণনামকেই বোঝায়, কিন্তু এই আত্মপ্রবঞ্চক মতুয়ারা হরিনাম বলতে কৃষ্ণনামকে বোঝায় না, তারা হরিনাম বলেত তাদের গুরু, হরিচাঁদের নামের অংশ ‘হরি’ কে বোঝায়, এজন্য যখন তারা বলে হরিবোল, তখনও সেটা হিন্দুধর্মের ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে বোঝায় না, বোঝায় হরিচাঁদকে।
এখানে আমার বক্তব্য হচ্ছে, যদি তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য নতুন ধর্মীয় মতবাদ মতুয়া বানায়, তাহলে তারা হিন্দুধর্মের শব্দ ও টার্মকে ব্যবহার করছে কেনো ? নাকি নতুন কিছু বানিয়ে নেওয়ার মুরোদ ও যোগ্যতা কোনোটাই তাদের নেই ? আর যাদের নতুন পথ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই, তাদেরকে পুরোনোদের দেখানো পথেই চলতে হয় এবং তাদেরকেই মানতে হয়। মতুয়ারা একদিকে নিজেরা নতুন কিছু বানাতে পারে নি, অন্যদিকে তারা সনাতন ধর্মের শব্দ, থিয়োরি ও টার্মকে ব্যবহার করছে, আবার সনাতন ধর্মকেই অস্বীকার করছে; এরা নিজের জন্মদাত্রীকে মা বলে, না বউ ভাবে, সেটাই তো দেখছি এখন এক বিরাট গবেষণার বিষয়।
আবার মতুয়াদের ধর্ম প্রচারককে বলে গোঁসাই, এটা গোস্বামী শব্দের একটি বিবর্তিত রূপ এবং এই শব্দও হিন্দুধর্মের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। তো যারা হিন্দু ধর্মকে মানে না, তারা হিন্দুধর্মের শব্দকে ব্যবহার করবে কেনো ? যে প্রশ্নটা আবারও করতে বাধ্য হলাম।

মতুয়াবাদে, সপ্তাহের একদিন প্রতি বুধবার সবাই মিলিত হয়ে হরিসভার আয়োজন করার নির্দেশ আছে; এছাড়াও হরিচাঁদের ভক্তরা বছরে একবার বা মাঝে মাঝে হরিচাঁদের স্মরণে হরিসভার আয়োজন করে থাকে। এই হরিসভায় তারা- খোল, করতাল, হারমোনিয়াম নিয়ে কীর্তন করে থাকে। এই প্রার্থনা বা গুরুর প্রশংসার জন্য কীর্তনের থিয়োরি তারা কোথায় পেয়েছে ? আর কীর্তনে যে বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার হয় সেটাই বা তারা কোন থিয়োরি থেকে নিয়েছে ? একই প্রশ্ন করছি খ্রিষ্টানদের উদ্দেশ্যেও, কেননা- তারাও গীর্জায় বসে বিশেষ দিনে যীশুর উদ্দেশ্যে হিন্দু স্টাইলে কীর্তন করে থাকে। বাপের খাবি, বাপের পড়বি, আর মা বাপকে গালি দিবি, একেবারে থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেওয়া দরকার, নির্বোধ, অকৃতজ্ঞ ও কুলাঙ্গার সব কোথাকার!
যা হোক, মতুয়াদের ধর্মগ্রন্থের নাম শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, এই হরিলীলামৃতের সামনে যে তারা ‘শ্রীশ্রী’ লাগিয়েছে, এই শ্রীটা কি তাদের বাপের ? ‘শ্রী’ একমাত্র সনাতনী তথা হিন্দুদের শব্দ, তাই যারা শ্রী ব্যবহার করবে, তাদেরকে অবশ্যই হিন্দু হতে হবে বা তারা হিন্দু হিসেবে বিবেচিত হবে, মতুয়া বা অন্য কিছু নয়। বাপের নাম তারা ব্যবহার করবে, আবার বাপকে মানবে না, এটা কোন ধরণের কথা ? প্রকৃতপক্ষে তারা কি ঠিক মতো জানে যে তাদের বাপ আসলে কে ?

আবার বুঝলাম, হরিচাঁদের নামের অংশ থেকে তারা হরি শব্দটি নিয়েছে, কিন্তু ‘লীলা’ শব্দটা কোথা থেকে নিয়েছে ? যে কৃষ্ণকে তারা উঠতে বসতে গালি দেয়, সেই কৃষ্ণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ লীলা, যার অর্থকে ঈশ্বরের কার্যকলাপ, সেই লীলা শব্দকে তারা নিয়েছে কেনো ? হরিচাঁদই যদি তাদের ভগবান হয়, তাহলে সে তাদেরকে নতুন শব্দ দিয়ে যেতে পারে নি কেনো ? এমনকি শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতের ‘অমৃত’ শব্দটাও হিন্দু ধর্মের শব্দ। এদেরকে আর কত গালি দেওয়া যায়, নিজেরও তো একটা প্রেস্টিজ বলে কথা আছে, বেশ্যা বা পতিতার সাথে ঝগড়া করে জিততে গেলে তো আর সভ্য সমাজে বাস করা যায় না !
হরিচাঁদের শিষ্যরা মতুয়াকে বলে আবার ধর্ম! এরা যদি ধর্ম শব্দের মানে জানতো, তাহলে আর এমন কথা মুখে আনতো না, এরা এমনই মূর্খ।

কোনো পদার্থ বা জীবের ধর্ম মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না, সৃষ্টি করতে পারে প্রকৃতি নামের ঈশ্বর। যেমন লোহার ধর্ম কাঠিন্যতা, জলের ধর্ম তারল্য, এটা প্রকৃতিই ঠিক করে দিয়েছে; তেমনি মানুষের ধর্ম কী, সেটা ঈশ্বরকে উপলব্ধিকারী হিন্দু মুনি ঋষিরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর সেটা হলো-
“পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ”-
অর্থাৎ, পরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার মতো জানবে
এবং
“মাতৃবৎ পরদারেষু, কন্যাবৎ পরকন্যাষু” –
অর্থাৎ, পরের স্ত্রী কন্যাদের মায়ের মতো দেখবে
খেয়াল করে দেখবেন, পৃথিবীর সকল অপরাধের মূল এই দুইটি বিষয়, পরের সম্পদ আর পরের স্ত্রী কন্যা। কিন্তু হিন্দুশাস্ত্রে এই দুটি বিষয়ের প্রতিই মানুষের আগ্রহকে জিরো করে দেওয়া হয়েছে। আর এই বিধান মেনে চলাই মানুষের ধর্ম, যাকে বলে মানবতাবাদ এবং এই বিধান একমাত্র হিন্দু শাস্ত্রেই দেওয়া আছে। একজন প্রকৃত মানুষ যেমন সব সময় এই বিধানই মেনে চলে, তেমনি এই বিধান মেনে চললে, ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিতি পাওয়ার বা বেঁচে থাকার জন্য অন্য কোনো বিধান মেনে চলবারই প্রয়োজন নেই।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দুটি বিধান মেনে চলাই যদি মানুষের ধর্ম হয় এবং সেই দুটি বিধানের কথা যদি সনাতন ধর্মে লিখা থাকে, তাহলে সনাতন ধর্মের যাগ যজ্ঞ পূজা পার্বন কেনো বা এগুলোর প্রয়োজন কী ?
এগুলো মানুষের জীবনের এক ঘেঁয়েমী কাটিয়ে চেঞ্জ আনার জন্য এক একটি উৎসব মাত্র, পরম্পরা রক্ষার্থে এগুলোকে ধর্মীয় আবরণ দেওয়া হয়েছে, যাতে এগুলো বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। অর যাগ যজ্ঞ হলো দেবতাদের কাছ থেকে বিশেষ কিছু পাওয়ার জন্য করা কর্ম, কেউ যদি তা না চায়, তার যজ্ঞ করার দরকার নেই।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃতিতে সৃষ্ট জীব ও জড়ের ধর্ম, প্রকৃতিই সৃষ্টি করে দিয়েছে, তাহলে কোনো ব্যক্তি, মানুষের জন্য যে বিধান দেয় তাকে কী বলে ?
তাকে বলে ইজম বা মতবাদ।
এই হিসেবে পৃথিবীতে একমাত্র ধর্ম সনাতন, যার অপর নাম সনাতন মানব ধর্ম বা হিন্দুধর্ম। আর বাকি গুলো সব ইজম বা মতবাদ, এই সূত্রে হরিচাঁদের মতুয়াও কোনো ধর্ম নয়, এটি একটি ব্যক্তিগত মতবাদ মাত্র। কারণ, প্রকৃতিতে সৃষ্ট জীব ও জড়ের ধর্ম সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে শুধু ঈশ্বরের, কোনো মানুষের নয়। মানুষ সৃষ্টি করতে পারে শুধু মত বা পথ, যাকেই ইংরেজিতে বলে ইজম, এই মতুয়াও একটি ইজম, কোনো রেলিজিয়ন বা ধর্ম নয়।
হরিচাঁদের একটি উক্তি হলো-
“কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।
বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।“
যারা নিজেকে কুকুর বা অসভ্য ভাবে, তাদের পক্ষেই কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাওয়া সম্ভব। আর যারা বেদ বিধি মানে না, তারাই শাস্ত্রে অসভ্য-বর্বর হিসেবে ম্লেচ্ছ ও যবন নামে পরিচিত, এদিক থেকেও মতুয়ারাও এই শ্রেণিরই।

আগেই বলেছি, হরিচাঁদ ছিলো নিরক্ষর, তাই সে বেদ পড়তে পারে নি, আর নিজের সেই আক্ষেপ ঢাকতে সে বেদের বিধি বিধানকেই বাতিল করে দিয়ে গেছে। এছাড়াও এই মূর্খ নিরক্ষর নিজেও কিছু লিখে যায় নি, তার হয়ে শ্রীশ্রীশ্রীহরিলীলামৃত লিখেছে দুজন, মহানন্দ হালদার এবং রসরাজ তারকচন্দ্র। অনেকে বলতে পারেন কৃষ্ণও তো নিজে কিছু লিখে নি, তাহলে হরিচাঁদ ও কৃষ্ণ কি একইরকম হলো না ? কৃষ্ণ নিজে কিছু না লিখলেও তিনিই বেদব্যাস হিসেবে আবির্ভূত হয়ে (গীতা, ১০/৩৭), সনাতন ধর্মের রক্ষার্থে বেদ গীতা সহ সকল সনাতন ধর্মীয় পুস্তক সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং কৃষ্ণের সাথে হরিচাঁদের তুলনা মানে- কোথায় হিমালয়, আর কোথায় উইয়ের ঢিবি ?
মতুয়াদের আরেকটি বিধান হলো-
"নাহি চেনে কোন দেবী, ঘট পট কিম্বা ছবি।”
-কোনো ছবিই যদি তারা না চিনে, তাহলে হরিচাঁদের ছবি সামনে রেখে তারা হরিসভা করে কেনো ?
এছাড়াও মতুয়াদের আরেকটি বিধান হলো-
“দীক্ষা নেই, করিবে না তীর্থ পর্যটন।”
-তাহলে তারা বছরে একবার হরিচাঁদের জন্মস্থান ওড়াকান্দিতে গিয়ে ভীড় জমায় কেনো ? ওড়াকান্দি কি হরিচাঁদের জন্য কিছু নির্বোধে লোকের কাছে তীর্থ স্থানে পরিণত হয় নি ?
মতুয়াদের আরেকটি জুয়াচুরি হলো-
“যাগ-যজ্ঞ তন্ত্র মন্ত্র দীক্ষা
কোন কিছুর নাহি প্রয়োজন ।
হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বজন ।।"
-আবারও বলছি, হরিনাম মন্ত্র বলতে সারাবিশ্বব্যাপী একমাত্র হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রকেই বোঝায়, তাই হরিনামের আড়ালে হরিচাঁদের কথা বলার কোনো অধিকার তাদের নেই; কারণ, হরিনাম শব্দের পেটেন্ট শুধুমাত্র হিন্দুদের, হিন্দু নামধারী মতুয়াদের নয়।
মতুয়াবাদে আরও বলা হয়েছে-
"দীক্ষা মন্ত্র দেয় গুরু কর্ণে মুখ রাখি ।
হরিনাম মন্ত্র বিনা, সব মন্ত্র ফাঁকি ।।"
-হরিনাম মন্ত্র বিনা তো সব মন্ত্রই ফাঁকি, এটা ঠিক আছে; কিন্তু সেই হরিনাম হরিচাঁদের নাম নয়, শ্রীকৃষ্ণের নাম। আর কানে মুখ রেখে গুরুর দীক্ষামন্ত্র দেওয়া খারাপ কিছু নয়, যতটা খারাপ মতুয়াদের হরিসভায় আবেগে আপ্লুত হয়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে জড়াজড়ি করে আলিঙ্গন করা।
মতুয়াবাদের আরেকটি কথা,
“নিজ নারী ভিন্ন অন্য নারীতে গমন ।
মহাপাপী ব্যভিচারী সেই একজন।”
-তাহলে হরিসভায় পরনারীকে জড়িয়ে ধরে আলঙ্গিন করে নারীদেহের উষ্ণতা অন্য পুরুষের দেহে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করে কিসের ইঙ্গিত দেওয়া হয় ?
হরিচাঁদের মাতা-পিতার নাম অন্নপূর্ণা দেবী ও যশোমন্ত বৈরাগী। তার মানে তার পিতা মাতা সনাতনধর্মী ছিলো, যেমন ছিলো গৌতম বুদ্ধে পিতা মাতা। বৌদ্ধরা যেমন স্বীকার করে না যে গৌতম বুদ্ধ ছিলো হিন্দু সন্তান, তেমনি হয়তো মতুয়ারা্ও স্বীকার করে না বা স্বীকার করতে ইতস্ততবোধ করে যে, হরিচাঁদের পিতা মাতা ছিলো হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী। দেশী গরুদের মিলনে গরুর বাচ্চা দেশী ই হয়; যদি দেখেন যে, দেশী গরুর পেট থেকে বিদেশী জাতের বাছুর বের হচ্ছে, তখন বুঝবেন যে, বীজটা দেশী গরুর নয়, ছিলো বিদেশী গরুর। হরিচাঁদের ক্ষেত্রেও সম্ভবত সেই ঘটনাটাই ঘটেছিলো। না হলে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণব পিতার সন্তান এমন কৃষ্ণ ও বেদ বিরোধী হয় কিভাবে ?

এবার হরিচাঁদের অদূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক মূর্খতার দিকে নজর দেওয়া যাক :
হরিচাঁদ চেয়েছিলো মতুয়া(হিন্দু) ও মুসলমানের মিলন, এজন্য সে বৈশ্য সাহা কন্যার সঙ্গে মুসলমান যুবক তিনকড়ি মিঞাঁর বিয়ে দিয়েছিলো এবং মতুয়াদের মতে- এই কাজ করে নাকি সেদিন তিনি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন !
কিন্তু যারা ইসলামের ইতিহাস জানে এবং কোরান হাদিসের কিছু জ্ঞান রাখে, তারা জানে যে, মুসলমানদের সাথে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মিলন- তেল ও জলের মতোই অসম্ভব। কেউ যদি মুসলমানদের সাথে মিলতে চায়, তাকে অবশ্যই মুসলমান হয়ে যেতে হবে। বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুসলমানরা কখনো তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না বা কোনো মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে না, তাহলে মুসলমানদের সাথে মিলনের চেষ্টা করে হরিচাঁদ, মতুয়া তথা হিন্দু সমাজের ক্ষতি করেছে, না লাভ ঘটিয়েছে ?
হরিচাঁদের এই মুসলমান প্রেমের কারণে বাঙ্গালি হিন্দুদের বিশেষ করে বাংলাদেশের হিন্দুদের কী পরিমান ক্ষতি হয়েছে এবার সেই ইতিহাসটা আপনাদেরকে বলি।

এই প্রবন্ধে- সীমিত অর্থে হরিচাঁদের অনুসারীদেরকে আমি মতুয়া নামে অভিহিত করলেও, এখন থেকে ব্যাপক অর্থে তাদেরকে হিন্দু হিসেবেই অভিহিত করছি; কারণ, রাষ্ট্রীয়ভাবে মতুয়াদের এখনও কোনো ধর্মীয় স্বীকৃতি নেই, না বাংলাদেশে, না পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে।
বর্তমানে বাঙ্গালি হিন্দু সমাজে যারা নমঃশুদ্র নামে পরিচিত, অতীতে তাদেরকে বলা হতো চণ্ডাল বা চাণ্ডাল, যার বিকৃত রূপ হলো চাঁড়াল। এই চাঁড়াল শব্দ দ্বারা বর্তমানে গালি বোঝালেও, এর মূল শব্দ চাণ্ডাল দ্বারা কিন্তু শক্তিশালী কিছুকে বোঝাতো বা বোঝায়। হরিচাঁদের পিতা মাতা চৈতন্যভক্ত হলেও, তাদের রূট ছিলো এই চাণ্ডাল এবং তারা টোটাল হিন্দু সমাজের কাছে ছিলো কিছুটা অপাংক্তেয় বা হীন। এই বিষয়টিই হরিচাঁদকে ভাবিয়েছিলো এবং সামাজিকভাবে তাদের মান উন্নয়নের জন্য সে বৃটিশ সরকারের সাথে দেন দরবার করে তার জনগোষ্ঠীর নাম চাণ্ডাল থেকে নমঃশুদ্র আদায় করেছিলো। এখনও যারা বাংলায় নমঃশুদ্র নামে পরিচিত, তারা হরিচাঁদের ভক্ত হোক বা না হোক, তাদের এই নমঃশুদ্র নামটি দিয়েছিলো হরিচাঁদই, সেটা তারা জানুক বা না জানুক।

ভারত ভাগের সময়, এই নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের একজন নেতা যোগেন মণ্ডল, যে ছিলো হরিচাঁদের অনুসারী এবং হরিচাঁদের মতোই মুসলমান প্রেমী, সে ভারত ভাগের সময় কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মুসলিম লীগ তথা মুসলমানদেরকে সাপোর্ট করেছিলো এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারত ভাগের জন্য যে ভোট হয় অর্থাৎ যে এলাকায় কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হবে সেটা হবে ভারতের এলাকা এবং যে এলাকায় মুসলিম লীগ প্রা্থী জয়ী হবে সেটা হবে পাকিস্তানের এলাকা, এই ভোটে যোগেন মণ্ডল এবং তার অনুসারী নমঃশুদ্ররা মুসলিমলীগকে সাপোর্ট ও ভোট দিয়েছিলো, ফলে বর্তমান বাংলাদেশের অনেক এলাকা যেটা ভারতের অন্তর্ভূক্ত হতে পারতো, তা হয় নি।

যা হোক, ভারত ভাগের পর যোগেন মণ্ডল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলো, কিন্তু তার নাকের উপর দিয়ে বিনা কারণে নমঃশুদ্র তথা হিন্দুরা একের পর এক বিভিন্ন জায়গায় মার খাচ্ছিলো, কিন্তু এর কোনো প্রতিকার যোগেন মণ্ডল করতে পারছিলো না। শেষ পর্যন্ত, পূর্ববাংলায়, হিন্দুরা কোনোভাবেই বাস করতে পারবে না, এটা উপলব্ধি করতে পেরে, যোগেন মণ্ডল পাকিস্তানের মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে এবং তার পদত্যাগের কারণ জানিয়ে পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে এবং তারপরেই সে কোলকাতায় পালিয়ে যায়।

প্রথমত যোগেন মণ্ডল ভারত ভাগই চায় নি, তার পর যখন ভারত ভাগকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো তখন সে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় এবং তাকে আবার শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ত্যাগ করে সেই ভারতে গিয়েই আশ্রয় নিতে হয়, নিয়তির পরিহাস এমনই নির্মম। যোগেন মণ্ডল যে পাকিস্তান তথা মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছিলো এটা ছিলো তার উপর হরিচাঁদের শিক্ষার প্রভাব এবং শেষ পর্যন্ত যোগেন মণ্ডলের জন্মভূমি ত্যাগ, এটা প্রমান করে যে হরিচাঁদের মুসলমান প্রেমের শিক্ষা ভুল ছিলো এবং তা এই বাংলার হিন্দুদের ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষতি করেছে।

মতুয়াবাদের গোড়া ওড়াকান্দি হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, কোলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে মতুয়াদের যে দেখা যায়, এদের প্রায় বেশির ভাগই ভারত ভাগের পরের সময় থেকে বাংলাদেশ থেকে জীবন রক্ষার তাগিদে পালানো জনগোষ্ঠী; এরা তাদের জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো হরিচাঁদের মুসলমান প্রেমের শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে।
হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের মিলনের বৃথা চেষ্টা না করে যদি হরিচাঁদ তার অনুসারীদেরকে মুসলমানদের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষা দিতো, তাহলে হয়তো যোগেন মণ্ডল মুসলিম লীগের পক্ষ না নিয়ে, কংগ্রেসের পক্ষ নিতো এবং তাহলে বর্তমান বাংলাদেশের অনেক ভূখণ্ড ভারতের অন্তর্ভূক্ত হতো এবং অনেক হিন্দুকে হয়তো তাদের ভিটা মাটি ছাড়তে হতো না। ইসলামকে না বুঝে যারাই মুসলমানদের সাথে হিন্দুদের মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছে, তারাই হিন্দুদের ক্ষতি করেছে, এই সারিতে শুধু হরিচাঁদই নয়, রয়েছে অখ্যাত অনেকের সাথে বিখ্যাত অনুকূলচন্দ্র এবং রামকৃষ্ণদেবও। রামকৃষ্ণ দেবের ‘যত মত তত পথ’ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বধর্মসমন্বয়ের চেষ্টা হিন্দুধর্ম ও সমাজের যে পরিমান ক্ষতি করেছে, তার কোনো তুলনা নেই।

যা হোক, এত কিছুর পরেও হরিচাঁদ ঠাকুর বা মতুয়া মতবাদের একটি বিষয় আমার ভালো লাগে, আর সেটা হলো- হরিচাঁদ ঠাকুর তার অনুসারীদেরকে কখনো সংসার ত্যাগ করে ধর্ম কর্ম করার উপদেশ দেয় নি, যেটা দিয়েছে চৈতন্যদেব। চৈতন্যদেবের মতো হরিচাঁদ নিরামিষ খাবারেরও পক্ষপাতি ছিলো না, তাই নমঃশুদ্রদের মধ্যে নিরামিষ খাবারের কোনো প্রচলন নেই, এটা জাতির স্বাস্থ্য রক্ষা পক্ষে একটি ভালো গাইড লাইন। সব মিলিয়ে মতুয়া মতবাদ একটি ভালো গার্হস্থ্য মতবাদ, কিন্তু এদের উপরের তলা পুরোটাই ফাঁকা; কারণ, কোনো ব্যক্তি কখনো ভগবান হতে পারে না, তাই তাকে ভগবান হিসেবে পূজা করে কারো কখনো লাভ হবে না বা তার কখনো মুক্তি প্রাপ্তি ঘটবে না।

মতুয়াবাদ ও হরিচাঁদ সম্পর্কে আমার কাছে যত তথ্য ছিলো, সে সবের আলোকে এই প্রবন্ধটি লিখলাম, এর বাইরেও কারো যদি কোনো বিষয় জানা থাকে বা জানার থাকে, আমাকে জানাবেন, আমি চেষ্টা করবো তার সমাধান দিতে।

জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment