Thursday 21 May 2020

দেবী লক্ষ্মী কে এবং রাধা কি লক্ষ্মীর অবতার ?


দেবী লক্ষ্মী কে এবং রাধা কি লক্ষ্মীর অবতার ?

মূল সংস্কৃত ভাগবত মতে- শ্রীকৃষ্ণ, কংসকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১০ বছর ২ মাস বয়সে বৃন্দাবন থেকে মথুরা চলে যান, এর পর তিনি আর কখনো বৃন্দাবনে ফিরে যান নি। রাধার সাথে কৃষ্ণের দেখা সাক্ষাত ঐ বৃন্দাবনেই, বাল্য কালে এবং শ্রীকৃ্ষ্ণের ১০ বছর ২ মাস বয়সেই তা শেষ। তাহলে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, যুবক কৃষ্ণের সাথে যুবতী রাধার দেখা হলো কোথায়, আর তাদের মধ্যে প্রেমই বা হলো কখন ? এ থেকে স্পষ্ট যে, কৃষ্ণের যুবক বয়সে রাধা বলে তার কোনো সঙ্গিনী বা সহচর ছিলো না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে রাধা- কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে এত কথা প্রচলনের কারণ কী বা কারা ছিলো এর পেছনে ?

মুসলমানরা ভারত দখল করে হিন্দুদের উপর দুটো ফরমান জারি করে- হয় ইসলাম গ্রহন, নয়তো মৃত্যু। এতে পরিস্থিতির শিকার ১০ জনের মধ্যে ৯ জন হিন্দুই মৃত্যুকে বরণ করেছে, বাকি একজন প্রাণের ভয়ে বা জিজিয়া কর দেওয়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহন করেছে। তাছাড়া যারা খুন-ধর্ষণ বা চুরি বা ডাকাতি করে বন্দী হতো, তাদেরকেও মুক্তি দেওয়া হতো ইসলাম গ্রহনের শর্তে, এভাবেও কিছু লোক মুসলমান হয়েছে।

কিন্তু মুসলমানদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণায় এবং মুসলমানদের সাথে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে হিন্দুরা যদি পাইকারী হারে জীবন দিতেই থাকে, তাহলে মুসলমানরা রাজ্য চালাবে কাকে নিয়ে ? এই সমস্যার সমাধানে, সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী হলেও ভারতের মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের উপর জিজিয়া করে চাপায়, যার ফলে তাদের দুটো সুবিধা হয়- প্রথমত, হিন্দুদেরকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের উপর ইচ্ছামতো নির্যাতন করে রাজ্য পরিচালনার মজা; দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের টাকায় জিজিয়া কর নিয়ে আরাম আয়েশে খাওয়া।

রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে মুসলমান শাসকরা হিন্দুদেরকে বাঁচিয়ে রাখলেও হিন্দু ধর্ম ও কালচারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য তারা একটি সুদূর প্রসারী প্ল্যান করে, আর এই পরিকল্পনারই অংশ হলো শ্রীকৃষ্ণের জীবনে রাধাকে আনয়ন। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ হলেন সনাতন তথা হিন্দু ধর্মের প্রধান প্রাণপুরুষ, তার চরিত্রকে যদি কোনোভাবে হেয় করা যায়, আর সেটা যদি কোনোভাবে হিন্দুদেরকে বিশ্বাস করানো যায়, তাহলে হিন্দুরা স্বেচ্ছায় সনাতন ধর্ম ত্যাগ করবে এবং ইসলাম গ্রহন করবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কোনো এক বেতন ভোগী হিন্দুকে দিয়ে লিখানো হয় ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’, যাতে প্রথম রাধার আবির্ভাব ঘটানো হয় এবং যুবতী রাধার সাথে যুবক কৃষ্ণের অনৈতিক ও পরকীয়া প্রেম এবং তার সাথে কৃষ্ণের যৌনতাকে তুলে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণকে লম্পট প্রমান করতে তাকে বিভিন্ন পুরাণের মাধ্যমে একাধিক বিয়েও দেওয়া হয় এবং এই সংখ্যা ১৬,১০৮ ! রাধা কৃষ্ণের প্রেম সংক্রান্ত সকল গল্প যে মিথ্যা, তার প্রমাণ হলো- ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে রচিত প্রাচীন কোনো গ্রন্থ যেমন- মূল সংস্কৃত ভাগবত, মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, বেদ কোথাও রাধার অস্তিত্বের কোনো উল্লেখ নেই।

যা হোক, মুসলমানদের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে না পেরে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের পর সংস্কৃত কবি জয়দেব, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা নিয়ে রচনা করে ‘গীত গোবিন্দ’ এবং সেই একই ঘটনা ঘটায় বাংলায় বড়ু চণ্ডীদাস নামের এক কবি ১৩৫০ সালের দিকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ লিখে; যেখানে শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ লম্পট চরিত্র। তারপর, এই কাব্যের ঘটনাকে ভিত্তি করে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে কয়েকজন বৈষ্ণব কবি রচনা করে বৈষ্ণব পদাবলী, যার মাধ্যমে রাধা কৃষ্ণের প্রেম একেবারে বাঙ্গালি হিন্দুদের মাথায় শেকড় গেঁড়ে বসে। এই সময় ই নিমাই এর আবির্ভাব হয় এবং সে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে পূর্বের সকল ষড়যন্ত্রকে বুঝতে না পেরে নিজেকে রাধা কৃষ্ণের যুগল অবতার হিসেবে বর্ণনা করে, যার ফলে রাধা, দেবীর মর্যাদায়, হিন্দুদের ঠাকুর ঘরে কৃষ্ণের পাশে জায়গা করে নেয়। রাধাকে বড় করে তোলার জন্য এবং তার মহিমা যে বিশাল, তা বোঝানোর জন্য চৈতন্যদেব পরবর্তী বৈষ্ণবরাই নানা কাহিনী বানিয়ে রাধাকে লক্ষ্মীর অবতার বানানোর চেষ্টা করে, তারা গীতা মাহাত্ম্য এবং কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধাকে ঢোকায়, আর এই ভাবে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে রাধার অস্তিত্ব এবং প্রচলিত হয় যে রাধাই লক্ষ্মী; আর এই কাহিনী খুব ভালোভাবেই, এই কারণে হিন্দুদেরকে বিশ্বাস করানো যায় যে, যেহেতু বিষ্ণুই কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী, সুতরাং বিষ্ণু পৃথিবীতে কৃষ্ণরূপে এলে, তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য লক্ষ্মীর পৃথিবীতে রাধা রূপে আসা অসম্ভব কিছু নয়। লক্ষ্মী পৃথিবীতে এসেছিলেন কিন্তু রাধারূপে নয় রুক্মিণীরূপে, যার প্রমাণ আছে হরিবংশে।

একটু আগেই গীতা মাহাত্ম্যে এবং কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধার প্রসঙ্গটা উল্লেখ করেছি, সে ব্যাপারে আরো কিছু বলা প্রয়োজন, না হলে প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে, যেটা আমার রচনার বৈশিষ্ট্য নয়।

গীতা মাহাত্ম্যে রাধা কিভাবে এলো, সে বিষয়ে-

“গীতা মাহাত্ম্যে রাধা: প্রকৃত রহস্যটা কী”

নামে আমার একটি প্রবন্ধ আছে, সেটা যারা পড়েছেন, বিষয়টি তারা জানেন; কিন্তু রাধার অস্তিত্ব প্রমাণে কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র যে চৈতন্যদেবের অনুসারীরা বানিয়েছে, সেটা বুঝতে পারবেন নিচের এই অংশটুকু পড়লে-

আমরা কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র হিসেবে যেটা জানি, তার শেষ দুই লাইন

“”ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।।“

এই অংশটি ঠিক আছে, এটা সংস্কৃতে রচিত এবং এর মাধ্যমে কৃষ্ণকে স্মরণ করা যায় এবং প্রণামও জানানো যায়। কিন্তু এর আগে কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে যা আছে, যেমন-

“”হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।।“

ভালো করে খেয়াল করে দেখুন তো এই অংশটুকু সংস্কৃত না বাংলা ? প্রচলিত কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রের শেষ দুই লাইন পুরো সংস্কৃত কিন্তু প্রথম দুই লাইন পুরো বাংলা হওয়ার কারণ কী ? আপনার কী মনে হয় মহাভারতের যুগের লোকজন, তাদের সময় থেকে কমপক্ষে ৪০০০ বছর পরে উৎপত্তি হয়েছে যে ভাষার, সেই বাংলায় তারা কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রের প্রথম দুই লাইন লিখে গিয়েছে ?

কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রের প্রথম দুই লাইন যে বাংলায় রচিত, তার প্রমাণ হলো এর প্রত্যেকটি শব্দ বাংলা। আবারও খেয়াল করুন শ্লোকের শব্দ গুলো-

হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।।

এখানে রাধাকান্ত মানে রাধার স্বামী, তার মানে বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে রাধার স্বামী বানাতেও দ্বিধা করে নি, কিন্তু কৃষ্ণ কি রাধাকে বিবাহ করেছিলো ?

করে নি।

তাহলে এই শ্লোকে কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে ‘রাধাকান্ত’ শব্দ ব্যবহার করার উদ্দেশ্যটা কী ?

উদ্দেশ্য হলো কৃষ্ণের জীবনে রাধার অস্তিত্বকে প্রমাণ করা, যাতে চৈতন্যদেব যে রাধা কৃষ্ণের যুগল অবতার, তা প্রমান করা যায় এবং চৈতন্যদেবের অবতার তত্ত্বকে টিকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু যা মিথ্যা তা আর কত দিন টিকে থাকে বা থাকবে ? তাই চৈতন্যদেবের বালির প্রাসাদও ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে।

নানা ছলচাতুরী করে চৈতন্যদেবের অনুসারীরা- গীতা মাহাত্ম্যে রাধাকে ঢুকিয়ে, কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধাকে জড়িয়ে, রাধাকে লক্ষ্মীর অবতার হিসেবে বর্ণনা করে, রাধার অস্তিত্ব প্রমানের নানা অপচেষ্টা করেছে, কিন্তু মূল সংস্কৃত ভাগবত এবং মহাভারত, যা কৃষ্ণের প্রামান্য জীবনী, সেখানে যুবক কৃষ্ণের সাথে যুবতী রাধার দেখা সাক্ষাতের কোনো প্রমান না থাকায় রাধা কৃষ্ণের প্রেম সম্পূর্ণ কাল্পনিক, তাই রাধার লক্ষ্মীর অবতার হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। এছাড়াও পৃথিবীতে অবতার আছে শুধু বিষ্ণুর, অন্য কোনো দেব-দেবীর নেই, তাই রাধাকে লক্ষ্মীর অবতার বলা মানেই একটা মিথ্যাকে অবলম্বন করে পথ চলা, যে পথে বৈষ্ণবরা চলছে, এমনকি ইসকনও।

আশা করছি, রাধা যে লক্ষ্মী নয়, তা সবার কাছে ক্লিয়ার হয়েছে; এবার নজর দিই তথাকথিত শিব দুর্গার মেয়ে লক্ষ্মীর দিকে।

মূল সংস্কৃত রামায়ণে, রাবন বধের পূর্বে, রামের দুর্গা পূজা করার কোনো কাহিনী না থাকলেও, যেহেতু কৃত্তিবাস ওঝা বাংলায় রামায়ণ অনুবাদ করার সময়, তার কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামকে দিয়ে দুর্গা পূজা করিয়েছে, সেহেতু বাংলায় ১৬০০ সালের দিকে দুর্গা পূজা শুরু হলে, তাতে শুধু দুর্গা অসুর, আর মহিষই ছিলো। কিন্তু পরে এটাকে ব্যাপক রূপ দেওয়ার জন্য, আস্তে আস্তে এর সাথে সকল দেব-দেবীকে যোগ করে এক মহাশক্তির ও মহামিলনের পূজায় রূপান্তরিত করা হয়। পৌরাণিকভাবে কার্তিক-গণেশ দুর্গার ছেলে; কিন্তু তাদের পাশে লক্ষ্মী-সরস্বতীর স্থান হওয়ায়, হিন্দুরা যেহেতু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ও প্রচারের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন, তাই প্রকৃত কাহিনী না জেনে হিন্দুরা যখন ছেলে মেয়ে নিয়ে দুর্গাপূজা দেখতে মন্দিরে গিয়েছিলো বা এখনো যায়, তখন ছেলে মেয়েরা জিজ্ঞেস করতো বা এখনও করে যে- মা, দুর্গার পাশে কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী, এরা কারা ? তখন বাপ মায়ের সহজ উত্তর ছিলো এরা দুর্গার ছেলে মেয়ে, ব্যস এইভাবেই চালু হয়ে গিয়েছিলো এই মিথ এবং হিন্দুদের নির্বুদ্ধিতা ও উদাসীনতায় তা চলে আসছে শত শত বছর ধরে।

২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে বহু নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা আমি হিন্দুদের সামনে তুলে ধরেছি, যেগুলোর মধ্যে একটি হলো-
লক্ষ্মী, সরস্বতী- দুর্গার মেয়ে নয়।

তাহলে লক্ষ্মী, সরস্বতী আসলে কে ?

দেবীদের উৎপত্তির ইতিহাসে, লক্ষ্মী-সরস্বতী, দুর্গারও সিনিয়র, যদিও তারা তিনজনই একই পদমর্যাদার দেবী; কারণ- সরস্বতী, লক্ষ্মী ও দুর্গা যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের নারী শক্তি।

কিন্তু এই ব্যাপারটার যুক্তিটা আসলে কী ?

হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ‘ব্রহ্ম’ বা ‘ঈশ্বর’ও বলা হয়। এই ব্রহ্ম তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন- ব্রহ্মা রূপে সৃষ্টি, বিষ্ণু রূপে পালন এবং মহাদেব বা শিব রূপে ধ্বংস। কিন্তু অজ্ঞতা ও বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে আমরা এতদিন অনেকেই মনে করেছি বা জেনে এসেছি যে, ব্রহ্মের তিনটি রূপ বা ব্রহ্ম তিনভাগে বিভক্ত, যথা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তাই আমরা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে আলাদা আলাদা তিনটি সত্ত্বা বিবেচনা করেছি এবং তাদের আলাদা মূর্তি প্রথমে কল্পনা ও পরে তৈরি করেছি; শুধু তাই নয়, তাদের প্রত্যকের স্ত্রী সৃষ্টি করেছি, পরে বহু দেবতার জন্ম দিয়েছি, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে সেরকম কিছু নয়।

একটু আগেই বলেছি- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়; ব্রহ্ম যখন সৃষ্টির কাজ করেন তখন তিনি ব্রহ্মা, যখন তিনি পালনের কাজ করেন তখন তিনি বিষ্ণু, আর যখন তিনি ধ্বংসের কাজ করেন, তখন তিনিই মহেশ্বর। একটি উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও সহজ হবে; ধরে নিন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি মন্ত্রণালয় আছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি ঐ মন্ত্রণালয়গুলোও দেখাশোনা করেন। এই অবস্থায় তিনি যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে ফাইলে সই করেন বা করবেন, তখন কিন্তু তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং ব্রহ্মের ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। তাই যদি না হয় তাহলে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার কৃষ্ণ, পালনের পাশাপাশি যুদ্ধ ও হত্যার মাধ্যমে পাপী ও দু্ষ্টদের বিনাশ করেছেন কেনো ? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে যদি আলাদা আলাদা সত্ত্বা্ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের কাজ ছিলো শুধু পালন করা, তার তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাঁধানোর কোন প্রয়োজন ছিলো না; প্রয়োজন ছিলো না শিশুকালেই রাক্ষসী ও অসুরদের, পরে কংস ও শিশুপালকে হত্যা করার এবং ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ ও দুর্যোধনকে হত্যা করানোর ? আসলে কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু, আর বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম। এজন্য বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে শুধু মানবরূপী কৃষ্ণই নয়, প্রত্যেকটি মানুষ ই যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন এক অর্থে সে ই ব্রহ্মা, যখন কাউকে পালন করে তখন বিষ্ণু এবং যখন কাউকে ধ্বংস করে তখন শিব। এভাবে এবং এইসব রূপেই প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে পরমব্রহ্ম বাস করে। এজন্যই ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩/১৪/১) ও বেদান্ত দর্শনে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

অর্থাৎ, সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম বিদ্যমান
বা প্রচলিত কথায়, “যত জীব, তত শিব”।

আগেই উল্লেখ করেছি, ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, তো প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কল্পনা করে নিয়েছি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমনকি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই; লেখক কর্তৃক- গল্প, উপন্যাসে একাধিক চরিত্র সৃষ্টির মতো সবই ব্রহ্মের খেলা, এখানে ব্রহ্মই সবকিছু । যা হোক, কোনো কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করতে হলে যেমন জ্ঞান লাগে, তেমনি সৃষ্টিকে নিখুঁত করার জন্য নজর রাখতে হয় চারেদিকে, এজন্যই কল্পনা করা হয়েছে ব্রহ্মার চারটি মাথা এবং তার নারীশক্তি সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে।

এবার আসা যাক বিষ্ণুতে। বিষ্ণু হলো ব্রহ্মার পালনকারী রূপের নাম। তো কাউকে পালন করতে কী লাগে ? ধন-সম্পদ। এই জন্যই বিষ্ণুর নারী শক্তি হলো লক্ষ্মী এবং তিনি ধন-সম্পদের দেবী।

এবার আসি শিব বা মহেশ্বরে। ব্রহ্মের ধ্বংকারী রূপের নাম শিব, মহেশ্বর বা রুদ্র। সৃষ্টি বা পালন করতে যেমন লাগে নারী শক্তি, তেমনি ধ্বংস করতেও লাগে নারী শক্তি। একারণেই রামায়ণের সীতা ও মহাভারতের দ্রৌপদীর জন্ম। এছাড়াও বিখ্যাত গ্রীস ও ট্রয়ের মধ্যকার যুদ্ধের কারণও ছিলো এক নারী, নাম হেলেন। নারী শক্তি যেমন ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তেমনি নারী নিজেও ধ্বংস করতে পারে। প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দিতেই ব্রহ্মের ধ্বংসকারী রূপ মহেশ্বর বা শিবের নারী শক্তি হলো দুর্গা, যার আরেক রূপের নাম কালী।

আশা করছি, উপরের এই আলোচনা থেকে লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুর্গার পরিচয় আপনারা পেয়েছেন এবং সেই সাথে এটাও বুঝতে পেরেছেন যে, লক্ষ্মী- সরস্বতী, দুর্গার মেয়ে নয়। এই ব্যাপারটাকে আরো সহজভাবে বোঝানোর জন্য আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি-

ধরে নিন, তিন ভাই, যাদের জন্ম একই সাথে, অর্থাৎ দু চার মিনিট আগে পরে অর্থাৎ যারা যমজ, প্রকৃত অর্থে এরা কিন্তু কেউ ছোট বড় নয়, একে অপরকে তুই তুকারি বলেও সম্বোধন করতে পারে, এই তিন ভাইয়ের স্ত্রীরাও কিন্তু পরিবারে একই সমান ক্ষমতা ও কতৃত্বের অধিকারী; দেব পরিবারের এই তিন ভাই হলো- বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও মহেশ্বর এবং তাদের তিন স্ত্রী বা নারী শক্তি হলো যথাক্রমে লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুর্গা।

আলোচনার মাঝখানে যে বলেছি, দেব-দেবীদের উৎপত্তির ইতিহাসে, লক্ষ্মী-সরস্বতী, দুর্গারও সিনিয়র, এখন সেই বিষয়টি মিলিয়ে দেখুন।

পোস্টের সাথে ফটো হিসেবে যে স্ট্যাটাসটি যুক্ত করেছি এবং সেখানে রাধা, কৃষ্ণ ও লক্ষ্মীকে নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে, আশা করছি এগুলোর একটি সহজ সমাধান এই প্রবন্ধে দিতে পেরেছি, তারপরও কারো যদি এ সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন থাকে নির্দ্বিধায় জানাবেন, ঈশ্বর আমাকে সে উত্তর জানানোর মতো সময় ও জ্ঞান প্রদান করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রী কৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment