Wednesday 20 May 2020

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মতে রাধা ও কৃ্ষ্ণের চরিত্রের স্বরূপ : (পর্ব-১)


ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মতে রাধা ও কৃ্ষ্ণের চরিত্রের স্বরূপ : (পর্ব-১)

হিন্দুধর্মের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে রাধার উল্লেখ না থাকলেও, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধার উল্লেখ আছে এবং এই পুরাণেই রাধার উৎপত্তি; এই পুরানে রাধার যে চরিত্র এবং কৃষ্ণের সাথে রাধার যে সম্পর্ক তা জানলে, শুনলে বা পড়লে আপনার মনে রাধা ও কৃষ্ণ সম্পর্কে শুধু ঘৃণার জন্মই হবে এবং আপনি যদি বিবেকবান লোক হন, আপনার মনে হবে- এই যদি হয় কৃষ্ণের চরিত্র এবং এই কৃষ্ণ যদি হয় হিন্দু ধর্মের প্রধান পুরুষ, তাহলে হিন্দুধর্ম কোনো ধর্মই নয়।

শুরুতেই জেনে নিন, এই পুরাণ রচনার রহস্য-

ভারতে মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার পর, হিন্দুদের প্রতি মুসলমান শাসকদের নির্দেশ ছিলো- হয় ইসলাম গ্রহন, নয় তো মৃ্ত্যু; এর ফলে ১০০ জনে ৯০ জন হিন্দু জীবন দিচ্ছিলো, কিন্তু ধর্মত্যাগ করছিলো না। এতে করে মুসলমান শাসকরা চিন্তা করলো, ধর্মের কারণে সব প্রজাকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে রাজ্য পরিচালনা করবে কাদের নিয়ে ? কারা দেবে খাজনা ? আর কিভাবেই বা বসে বসে খাওয়ার অর্থ কড়ি আসবে? তাই তারা, সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী হলেও জিজিয়া করের বিনিময়ে ধনী হিন্দুদেরকে বাঁচিয়ে রাখে এবং আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করার জন্য রচনা করে এক দীর্ঘ পরিকল্পনার, যার ফসল হলো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ।

ইসলামে কবিতা লিখা হারাম, তাই মুসলমান শাসকরা রাজসভায় রাখতো হিন্দু কবিদের এবং তার থেকে তারা কাব্যরস আস্বাদন করতো। এই রকম কোনো এক হিন্দু কবিকে দিয়ে কোনো এক মুসলমান শাসক লিখায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং রচয়িতা হিসেবে নাম দেয় বহু পুরাণ রচয়িতা বেদব্যাসের নাম। ফলে সাধারণ হিন্দুরা ধোকা খায় এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান রচনার আসল উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পেরে এই পুরাণের কথাকে বিশ্বাস করে ক্ষতি করে বসে হিন্দুধর্ম ও সমাজের।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই প্রথম রাধার উৎপত্তি এবং রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেম ও যৌনলীলার শুরু, যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার; কারণ- হরিবংশ, মহাভারত, সংস্কৃত মূল ভাগবত যাতে কৃষ্ণের প্রামান্য জীবনী রয়েছে, সেগুলোতে রাধার নামের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণের যে চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা হরিবংশ, মহাভারত এবং সংস্কৃত মূল ভাগবতের কৃ্ষ্ণের যে চরিত্র, তার সাথে মোটেই মিল নেই। এই সমগ্র বিষয় উপলব্ধি করলেই বোঝা যায় যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ লিখাই হয়েছিলো সনাতন ধর্মের প্রধান পুরুষ কৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করার জন্য।

একটা বিষয় খেয়াল করুন, হরিবংশ, ভাগবত এবং মহাভারতে কৃষ্ণের একজন স্ত্রীর কথা বলা হয়েছে তিনি রুক্মিনী, তার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের কথা বাদ দিয়ে এক নারীকে তার কৃষ্ণের পাশে দাঁড় করানো হয়, যিনি অন্যের স্ত্রী, আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা হয় তিনি নাকি কৃষ্ণের মামী। যদি কৃষ্ণের সাথে এমন একটি মেয়ের প্রেম ও বিয়ের সম্পর্কের কথা বলা হতো, যেটা সাধারণ, যেমন রুক্মিনী, তাহলে কিন্তু কোনো কথা ছিলো না; কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক এবং তার পৃষ্ঠপোষকদের উদ্দেশ্য ছিলো তো অন্য, তাই তারা কৃষ্ণের পাশে এমন একজনকে দাঁড় করিয়েছে, যার সাথে কৃষ্ণের সম্পর্ক হয়েছে অনৈতিক ও অবৈধ, উদ্দেশ্য একটাই, এর মাধ্যমে কৃষ্ণ চরিত্রকে ধ্বংস করা গেলে সমগ্র হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করা যাবে এবং ভারতে ইসলামকে কায়েম করা যাবে।

যা হোক, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অবলম্বনে এই পুরাণে বর্ণিত রাধা ও কৃষ্ণের চরিত্রকে তুলে এনে আপনাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, রাধাকে নিয়ে কৃষ্ণ সম্পর্কে যা বলা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা, এই ঘটনা সীমাবদ্ধ শুধু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই, আর বাংলা পদ্য ভাগবতগুলোতে রাধাকে নিয়ে যেটুকু বলা আছে, তা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেরই প্রভাব এবং বহুল প্রচারণার ফল।

নিচে দেখে নিন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে- আসলে রাধা ও কৃষ্ণকে কিভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে এবং দিব্যজ্ঞানীরা যেটা বলে থাকে যে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম- অপ্রাকৃত অপার্থিব, সেটা প্রকৃতই সত্য কি না ?

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ- ব্রহ্মখণ্ড, প্রকৃতি খণ্ড, গণপতি খণ্ড এবং শ্রীকৃষ্ণজন্ম খণ্ড- এই চার খণ্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণজন্ম খণ্ডের বিভিন্ন পর্ব বা অধ্যায়ে রাধা সম্পর্কে বলা হয়েছে। শুরুর দিকে "শ্রীমতির ভয়ে বিরজার নদীরূপ পরিগ্রহ" পর্বে বলা হয়েছে-

একটি নির্জন কাননে অর্থাৎ বনে রাধার সাথে তার স্বামী কৃষ্ণ, বিচরণ করছে এবং মনের সুখে বিহার অর্থাৎ যৌনক্রিয়া করছে, এমন সময় কৃষ্ণের, তার অপর স্ত্রী বিরজার কথা মনে পড়ে এবং তার সাথে যৌনক্রিয়া করার জন্য সেখান থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় এবং বিরজার ভবনে এসে হাজির হয় এবং বিরজার সাথে যৌনক্রিয়া শুরু করে। এটা দেখে ফেলে রাধার এক সখী এবং সে দ্রুত যায় রাধার বাড়িতে এই খবর দিতে।

এখানে খেয়াল করুন, নির্জন বনে ছিলো রাধা এবং কৃষ্ণ, সেখান থেকে কৃষ্ণ হঠাৎ উধাও হয়ে যায় এবং গিয়ে ঢোকে বিরজার ভবনে, সেই প্রাসাদোপম ভবনের কোনো একটি কক্ষে- কৃষ্ণ, বিরজার সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয়, যেটা দেখে ফেলে রাধার এক সখী এবং সে যায় সেই ঘটনার কথা বলতে রাধার বাড়িতে, এটা কীভাবে হয়, রাধা তো তখন বনেই ছিলো এবং বিরজার বাড়িতে ঢুকে কৃষ্ণ যে বিরজার সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছে, সেটা রাধার সখী বাইরে থেকে দেখলো কিভাবে? আর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, বিরজা ছিলো কৃষ্ণের স্ত্রী, তাহলে তার সাথে কৃষ্ণ যদি যৌনতায় লিপ্তই হয়, এতে কৃষ্ণের অপরাধ কী ? ঘটনা বানিয়ে বানিয়ে লিখলে এমনই হয়, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের লেখকের যে স্থান কাল পাত্রের কোনো জ্ঞান ছিলো না, এটা নিশ্চিত, না হলে সে এমন অবাস্তব দৃশ্য রচনা করতে পারতো না, অথচ এই পুরাণ চালানো হয়েছে মহামতি বেদব্যাসের নামে, যে বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছেন, যাতে তিনি কৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং যে মহাভারতের কাহিনীর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে এই প্রবাদ প্রচলিত যে, মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে ? এর মানে মহাভারতের মধ্যে কোনো কিছু ভুল নেই, এমন বিশুদ্ধ মহাভারতের যিনি রচয়িতা, তার হাতে কি এমন উদ্ভট কাহিনী সমৃদ্ধ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচিত হতে পারে ?
যা হোক, কৃষ্ণ যখন বিরজার সাথে যৌনতায় লিপ্ত এবং সেই খবর যখন রাধার কোনো এক সখী রাধাকে দিলো, তখন রাধা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তার সখীদেরকে বলে, তোরা সব চল আমার সাথে, আজ দেখবো বিরজা সুন্দরী কেমন, তার কী অবস্থা করি তোরা সব আজ দেখবি, আমার স্বামীকে নিয়ে বিছানায় শোয় এমন সাহস তার হলো কিভাবে ?

রাধার বলা এসব কথায় মনে হয়- যেন বিরজা, কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমিকা, তার ঘরে ঢুকে কৃষ্ণ মহা অন্যায় করে ফেলেছে, তাই তার শাস্তি দিতে রাধা যাচ্ছে বিরজার ভবনে; শুধু তাই নয়, বিরজার ভবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, রাধা, কৃষ্ণ সম্পর্কে মন্তব্য করছে- সে কেমন স্বামী যে এমন কর্ম করে, তার অন্তরে কি কোনো ভয় ডর নেই ? উচিত শাস্তি আজ দেবো তাকে, কপালে যা আছে তা হবে, লম্পটের চরিত্র কোনো দিন শুধরায় না; এই বলে রাধা কৃষ্ণের ভবনের দিকে রথে চড়ে গমন করে, তার সাথে যায় তিন কোটি গোপী! খেয়াল করুন সংখ্যাটি তিন কোটি !

যা হোক, রাধা যাচ্ছে তিন কোটি সঙ্গী সাথী নিয়ে কৃষ্ণের ভবনে, বিরজার সাথে কৃষ্ণ যৌনক্রিয়া ক'রে, রাধার মতে কৃষ্ণ যে অপরাধ করেছে, তার শাস্তি দিতে ! বিরজা থাকে কৃষ্ণের ভবনে, তার মানে বিরজা কৃষ্ণের বৈধ স্ত্রী; আর রাধা, কৃষ্ণের সাথে দেখা করে জঙ্গলের মধ্যে, এতেই প্রমানিত হয়, রাধা, কৃষ্ণের বৈধ বা সমাজ স্বীকৃত স্ত্রী নয়, অবৈধ বা গোপনে বিয়ে করা স্ত্রী; অথচ এই অবৈধ স্ত্রী যাচ্ছে, তার স্বামীকে এবং স্বামীর বৈধ স্ত্রীকে শায়েস্তা করতে তাদের স্বাভাবিক যৌন মিলনের জন্য, এরকম অবাস্তব এবং উদ্ভট ঘটনা পৃথিবীর কোথাও না ঘটলেও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক তা ঘটিয়েছে এবং এটাকে হিন্দুরা ধর্মগ্রন্থ মনে করে তার শ্রদ্ধা ও পূজা করছে, হিন্দুদের বর্তমান দূরবস্থা আর পতন কি আর এমনি এমনি ?

এখানে আরেকটি তথ্যের দিকে নজর দিন, তিন কোটি গোপীকে নিয়ে রাধা যাচ্ছে কৃষ্ণের বাড়ি ঘেরাও করতে, সেই ৫ হাজার বছর আগে সারা ভারত মিলে ১ কোটি মানুষ ছিলো কিনা সন্দেহ, আর রাধা বৃন্দাবনেই পেয়ে যাচ্ছে তিন কোটি গোপী অর্থাৎ তিন কোটি যুবতী নারী ! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক কী পরিমান গাঁজা খেয়ে কলম ধরেছিলো, সেটা একবার কল্পনা করুন।

যা হোক, কৃষ্ণের ভবনে রাধা পৌঁছে দেখে গেটে পাহারা দিচ্ছে শ্রীদাম এবং সে রাধাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে নারাজ, তখন রাধা, শ্রীদামকে বলে-

লম্পটের সহচর তুমি পাপাচার।
পলাও দূরেতে ত্বরা পাপের আধার।।
শ্রীহরি লম্পট যথা তুমিও তেমন।
ত্বরা পথ ছাড়ো দুষ্ট আমার বচন।।
তোমার বচনে রব কিসের কারণ।
ত্বরা করে যাবো আমি কৃষ্ণের ভবন।।
দেখিব লম্পটে আমি কিরূপ সে জন।
ত্যজ দুষ্ট ত্বরা দ্বার কহিনু বচন।।

অর্থাৎ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, রাধাই কৃষ্ণকে লম্পট বলে মনে করতো, সেই রাধাকে না ভজলে নাকি কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে না, যে রাধার মনে কৃষ্ণ সম্পর্কে কোনো শ্রদ্ধা ভক্তিই ছিলো না।

যা হোক, শ্রীদাম, রাধাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না, আর রাধা ভেতরে ঢুকবেই, এই নিয়ে গেটে চলছে ঘোর বিবাদ, এই খবর যখন কৃষ্ণের কাছে যায়, তখন কৃষ্ণ ভয় পেয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায় অর্থাৎ লুকিয়ে পড়ে; খেয়াল করুন, এই সেই কৃষ্ণ- যিনি আঙ্গুলের উপর পর্বত তুলে ধরেছিলেন, ভয়ংকর কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন, ভয়ংকর সব রাক্ষসদেরক শিশু ও বাল্যকালেই হত্যা করেছিলেন, বাল্যকালেই কংসের মতো শক্তিশালী যোদ্ধাকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করেছিলেন, চারজনের পক্ষে যে ধনুক তোলা সম্ভব নয়, মথুরায় সেই ধনুক কৃষ্ণ একাই তুলে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন, একাই পাঞ্চাল রাজের পুরো বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দ্রৌপদীকে কন্যা হিসেবে স্বীকার করতে পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদকে বাধ্য করেছিলেন, শান্তি প্রস্তাব নিয়ে একাই হস্তিনাপুর গিয়ে দুর্যোধনের হাতে বন্দী হয়ে সেই কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের নিক্ষেপ করা তীরের সামনে নির্ভিক চিত্তে দাঁড়িয়েছিলেন- এই কৃষ্ণ নাকি রাধার ভয়ে লুকাচ্ছে! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের লেখকের লাগামছাড়া কল্পনায় সত্যিই আমি মুগ্ধ।

যা হোক, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, কৃষ্ণের অবৈধ প্রেমিকা বা স্ত্রী রাধার ভয়ে কৃষ্ণ একাই লুকায় নি, কৃষ্ণের স্ত্রী বিরজাও রাধার ভয়ে জলের রূপ ধরে নদী হয়ে প্রবাহিত হয়েছিলো, হ্যাঁ, সেই কথাই লেখা আছে ব্রহ্মববৈর্ত পুরাণে, দেখুন নিচে-

রাধিকার ভয়ে হরি অন্তর্হিত হৈল।
কোপ ভরে রাধা শেষে পুরে প্রবেশিল।।
বিরজা জলের রূপ ধরিল সভয়ে।
নদী জলে নিজ অঙ্গ রাখিল লুকায়ে।।

বিরজা যে নদীতে পরিণত হলো, সেই নদীর রূপ নাকি অপরূপ, হংস হংসী সেই জলের উপর শুধু ক্রীড়াই করে নি, যোগীগন সেই নদীর তীরে যোগাভ্যাস করেছে, সন্ন্যাসীরা তপস্যা করেছে।

যা হোক, তারপর রাধা, কৃষ্ণ এবং বিরজাক খুঁজে না পেয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলে কৃষ্ণ স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে সেই নদীর পাশে দাঁড়ায়, নদীরূপ বিরজাকে নিরীক্ষণ করে, অন্তরে কাতর হয়, কান্না করে নদীর তীরে বসে, বলে- তুমি জলের রূপ ত্যাগ করে দেহ ধারণ করে আমার কাছে ফিরে এসে আমার জীবন বাঁচাও; রাধা ভক্তদের কাছে এই রাধাই নাকি কৃষ্ণের পরম প্রেয়সী, কৃষ্ণের প্রেমের গুরু, তাহলে সেই রাধাকে ছেড়ে কৃষ্ণ বিরজা প্রেমে এমন ব্যাকুল কেনো ?

রাধা ভক্তরা, পারলে এর জবাবটা দিয়ে যাবেন।

যা হোক, কৃষ্ণের কাতর অনুরোধে বিরজা জলের রূপ ছেড়ে আবার মানবীর রূপ ধরে এবং কৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়, এতে বিরজার গর্ভ সঞ্চার হয়, সেই গর্ভ নাকি শত বছর ধরে থাকে এবং তারপর তা থেকে একে একে কৃ্ষ্ণের সাতটি পুত্রের জন্ম হয়।

বিরজা নাকি শত বর্ষ ধরে গর্ভধারণ করেছিলো, ওরে কেউ যদি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক এবং তার সমর্থকদের সন্ধান পাস, তাদেরকে দুই ছিলিম গাঁজা বেশি দিস।

এখানেই শেষ নয়, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক, কৃষ্ণকে কী পরিমাণ লম্পট হিসেবে তুলে ধরেছে তার পরিচয় পাবেন নিচের এই ঘটনায়- শ্রীকৃষ্ণের শাপে বিরজার পুত্রগণের সাগররূপ পরিগ্রহ- পর্বে:

একদিন শ্রীকৃষ্ণ, তার স্ত্রী বিরজার সাথে যৌন ক্রিয়া করছিলো, ভবনের বাইরে তার সাত পুত্র খেলা করছিলো, এমন সময় পুত্রেরা একে অপরের সাথে ঝগড়া মারামারি করে এবং সেই অভিযোগ এসে জানায় মায়ের কাছে, মা তখন, তাদের পিতা কৃষ্ণের সাথে যৌন ক্রিয়ায় রত ছিলো, পুত্রেরা ঘরে ঢুকে পড়ায়, কৃষ্ণের যৌন ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে এবং কৃষ্ণ ক্ষেপে গিয়ে তার পুত্রদেরকে অভিশাপ দেয়। এই ঘটনার বর্ণনা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রয়েছে এই ভাবে-
একদা শ্রীহরি দেব বিরজার সনে।
করিছেন কত কেলি বসি একাসনে।
সহসা বিরোধ করি যত পুত্রগণ।
জননী সকাশে আসি করে নিবেদন।।
তনয়ে দেখিয়া কৃষ্ণ কোপ পরায়ণ।
রতি ছাড়ি কালশশী উঠেন তখন।।
বিরজা তনয়গণে অঙ্কেতে লইল।
রতিভঙ্গে জনার্দন কুপিত হইল।
সম্বোধিয়া জনার্দন সপ্ত পুত্রগণে।
অর্পিলেন অভিশাপ আরক্ত নয়নে।।
আমার বচন শুন তনয় নিকর।
সপ্তজনে হবি তোরা সাতটি সাগর।

-এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের উদ্দেশ্য যে লম্পট হিসেবে তুলে ধরে কৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করা এবং এভাবে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে খেয়ে ফেলে হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করা, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞান বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না, দিব্যজ্ঞানী না হয়ে একটু কাণ্ডজ্ঞানী হলেও হয়। অথচ এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণকে বেদব্যাসের নাম দিয়ে চালানো হয়েছে এবং হয়, গীতা অনুসারে যে বেদব্যাস নিজেই শ্রীকৃষ্ণ এবং যে বেদব্যাস- মহাভারত, ভাগবত এবং হরিবংশের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে তুলে ধরেছেন, সেই বেদব্যাস কিভাবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণকে এমন লম্পট এবং যৌনকাতর ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারেন ? সুতরাং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ যে বেদব্যাসের লেখা নয়, এ বিষয়ে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই।

এরপর - রাধিকার প্রতি শ্রীদামের অভিশাপ- পর্বের শুরুতেই বলা হয়েছে-

সমাগতা যবে রাধা বিরজার দ্বারে।
শ্রীদাম না ছাড়ে দ্বার রাধিকা সতীরে।।
কোপ ভরে গেলো রাধা নিজের আলয়।
শ্রীদামের প্রতি হৈল কোপ অতিশয়।।

-খেয়াল করুন, এখানে বলা হচ্ছে শ্রীদাম, রাধাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় নি; কিন্তু আগের পর্বে বলা হয়েছিলো-

রাধিকার ভয়ে হরি অন্তর্হিত হৈল।
কোপ ভরে রাধা শেষে পুরে প্রবেশিল।।

যা হোক- রাধা, দল বল নিয়ে কৃষ্ণের ভবনে এসে কৃষ্ণ ও বিরজাকে শাস্তি দিতে না পেরে রেগে মেগে নিজের ভবনে চলে যায় এবং তারপর কৃষ্ণও সেখানে গিয়ে হাজির হয়, কৃষ্ণকে দেখে রাধা আরও ক্ষেপে যায় এবং রাগে তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। তারপর -

কোপভরে কৃষ্ণ প্রতি শ্রীমতি কহিল।
এ কি দেখি ওহে হরি তব কীর্তি ভাল।।
এখানে কিসের লাগি কৈলে আগমন।
বিরজা সমীপে যাও বিরজার ধন।।

অথচ আগের পর্বে বলা হয়েছিলো, বিরজা নদীরূপ ধারণ করলে শোকে কৃষ্ণ সেই নদীর তীরে গিয়ে কান্নাকাটি করে বিরজাকে পুনরায় মানবী রূপ ধারণ করে তাকে বাঁচাতে বলেছিলো। এই কৃষ্ণ নাকি আবার রাধার মান ভাঙ্গাতে গিয়েছিলো রাধার বাড়ি! কৃষ্ণ যেহেতু ঈশ্বর, তাই একই সাথে দুই জায়গায় অবস্থান করা তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু কৃষ্ণের চরিত্রে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কেনো ? কৃষ্ণ, প্রেম ও যৌনতার জন্য একবার রাধার কাছে, আরেকবার বিরজার কাছে দৌড়াচ্ছে কেনো ? নাকি এমনভাবে তুলে না ধরলে কৃষ্ণকে লম্পট হিসেবে প্রমান করা যায় না ?

যা হোক, রাধার কাছে গেলে, রাধা, কৃষ্ণকে নানা কথা বলে, তারপর-

ইহা শুনি জনার্দন কহেন রাধারে।
কেন প্রিয়ে তিরস্কার করিতেছ মোরে।।
না জানি কিছুই আমি ওগো প্রাণ প্রিয়ে।
তোমার বাক্যেতে কষ্ট পেতেছি হৃদয়ে।।

-কৃষ্ণ নাকি কিছুই জানে না, এই কৃষ্ণ নাকি আবার ঈশ্বর ! রাধার ভয়ে কৃষ্ণ লুকিয়ে থাকলো, আর একটু পরেই রাধার বাড়িতে গিয়ে বলছে, কী হয়েছে, আমি তো কিছুই জানি না, তুমি আমাকে তিরস্কার করছো কেনো, কষ্ট পাচ্ছি।

এই ঘটনার মাধ্যমে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক কৃষ্ণকে শুধু লম্পটই নয়, মিথ্যাবাদি হিসেবেও তুলে ধরেছে।
যা হোক, তারপর-

শুনিয়া পতির বাক্য রাধা সতী কয়।
এখন জান না কিছু ওহে দয়াময়।।
শুন হে লম্পট নাথ বচন আমার।
বিরজা সনেতে এবে করহ বিহার।।

-রাধার এসব কথা শুনে কৃষ্ণ নানা কথা বলে রাধাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, কিন্তু-

শ্রীকৃষ্ণ যতেক কহে বিনয় বচন।
শ্রীমতি ততই হয় কোপ পরায়ণ।।
কোপ হেরি জনার্দন স্থানান্তরে যায়।
পুনশ্চ আসিয়া ধরে শ্রীমতির পায়।। (কৃষ্ণ, রাধার পা ধরছে, অবস্থা চিন্তা করুন।)
পুনঃ পুনঃ যাতয়াত করে জনার্দন।
শ্রীদাম সনেতে বনে করেন সান্ত্বন।।
কিছুতে কোপের শান্তি না হয় রাধার।
স্থানান্তরে যান হরি দয়ার আধার।।

-কৃষ্ণের এই অবস্থা দেখে শ্রীদাম যায় রাধার কাছে এবং বলে-

একি দেখি ওগো সতী তব আচরণ।
কৃষ্ণের বিনয় বাক্য করিলে লঙ্ঘন।।
কি হেতু কুপিতা এত হয়েছ বল না।
ব্রহ্মাণ্ডের পতি কৃষ্ণ তাহা কি জানো না।।

-যেই শ্রীদাম রাধার পথ আটকানোয় এত ঘটনা ঘটলো, যেই শ্রীদাম রাধার রাগের মূল কারণ, সেই শ্রীদাম রাধাকে গিয়ে বলছে, তোমার এত রাগের কারণ কী ? ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক মনে হয় একবেলা মুখ দিয়ে খবার খেতো, অন্যবেলা পাছা দিয়ে।

যা হোক, তারপর-

শ্রীদামের বাক্য শুনি শ্রীরাধিকা সতী।
ঘূর্ণিত নয়নে চান শ্রীদামের প্রতি।।
মোর নিন্দা কর তুমি ওহে পাপাচার।
হরির প্রশংসা মুখে কর অনিবার।। ( রাধা, কৃষ্ণের প্রশংসাই সহ্য করতে পারছে না।)
দানবরূপেতে তুমি লইয়া জনম।
আসুরিক কর্মে সদা রহিবে মগন।।
অভিশাপ দিনু আমি ওরে অভাজন।
শ্রীকৃষ্ণ সমীপে গিয়ে বলহ এখন।।

তারপর-

অভিশাপ বাক্য শুনি শ্রীদাম তখন।
বলিলেন কোপভরে রাধারে বচন।।
বিনা দোষে অভিশাপ করিলে প্রদান।
উপযুক্ত পাবে ফল নাহি হৈবে আন।।
গোপ গৃহে হৈবে জন্ম হইবে গোপিনী।
মানবী আকারে যাবে অবশ্য ধরণী।।

- এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীদাম ও রাধার এই কথোপকথন কোথায় হচ্ছে, পৃথিবীতে না স্বর্গে ? যদি স্বর্গে হয়ে থাকে, তাহলে শ্রীদাম ও রাধা হবে দেব-দেবী এবং তাদের নাম হবে অন্য; আর পৃথিবীতেই যদি হয়, তাহলে রাধার জন্ম মানবী রূপে গোপ গৃহে তো হয়েছেই, আবার এই কথা আসছে কেনো ? যে কাহিনী মিথ্যা, সেটা নিয়েই এত প্রশ্ন তোলা সম্ভব, সত্য কাহিনী এসবের উর্ধ্বে।

এই স্বর্গীয় কথাবার্তার বাকি অংশ হলো-
আয়ান হৈবে স্বামী আমার কথায়।
ক্লীববেশি জ্ঞানবীর আয়ানের কায়।।
কৃষ্ণ অংশে জন্ম তার হরি মায়াধারী।
বিবাহ করিবে তোমায় শুন গো ঈশ্বরী।।
কৃষ্ণগানে সদা তুমি করিবে বিহার।
বৃন্দাবনে রবে দোঁহে কহিলাম সার।।
শত বর্ষ কৃষ্ণ সহ বিচ্ছেদ হইবে।
বিষম যাতনা তাহে অবশ্যই পাইবে।।
তারপর গোলকেতে হইবে আগমন।
কৃষ্ণের সনেতে আসি লভিবে মিলন।।

-তারপর গোলকেতে হইবে আগমন। এই কথার মাধ্যমে অবশেষে বোঝা গেলো যে শ্রীদাম ও রাধার এই সব কথাবার্তা চলছে গোলকে, কিন্তু যে কারণে বা যে ঘটনা থেকে এইসব কথাবার্তার সূত্রপাত, সেই ঘটনা কি গোলোকে ঘটেছিলো ? ঘটে নি। এই ঘটনার সূত্রপাত পৃথিবীতে- রাধা, কৃষ্ণ ও বিরজার ত্রিমুখী প্রেম ও যৌনতাকে ঘিরে, তাহলে এখানে আবার গোলোকের কথা আসছে কোথা থেকে আর গোলোকের বর্ণনায় রাধা-কৃষ্ণ-শ্রীদাম এই নামগুলোই বা আসবে কেনো ? শ্রীকৃ্ষ্ণের নাম গোলোকে তো নারায়ণ, আর নারায়ণের নারী শক্তির নাম লক্ষ্মী বা যোগমায়া, গোলোকের বর্ণনা হলে নামগুলো হবে নারায়ণ, লক্ষ্মী, যোগমায়া এরকম; গোলোকে- রাধা, কৃষ্ণ, শ্রীদাম নামে তো কেউ নেই।

যা হোক, রাধার অভিশাপ পেয়ে শ্রীদাম যায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে এবং কৃষ্ণ, তাকে বলে রাধার অভিশাপ অবশ্যই ফলবে, তুমি দানব শঙ্খচূড় হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নেবে এবং তুলসীর সাথে তোমার বিয়ে হবে। অথচ পৌরাণিক কাহিনী মতে, দেবী বৃন্দা, পরে যিনি তুলসী নামে খ্যাত হন, তার বিয়ে হয় দানব জলন্ধরের সাথে এবং জলন্ধরের উৎপত্তি হয়েছিলো শিবের ক্রোধ থেকে, তার মানে জলন্ধর ছিলো শিবের অংশ এবং এই ঘটনাগুলো পুরোটাই পৌরাণিক, কিন্তু কৃ্ষ্ণের ঘটনা ঐতিাসিক, আর কৃষ্ণের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে রাধা ও শ্রীদামের ঘটনাও হবে ঐতিহাসিক। আর ঐতিহাসিক ঘটনা মানে পৃথিবীর ঘটনা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মানুষ- রাধা ও শ্রীদাম, একে অপরকে স্বর্গের দেব-দেবীর মতো অভিশাপ দিচ্ছে এবং শ্রীদাম রাধাকে যে অভিশাপ দিচ্ছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে- সেই ভাবে রাধার জন্ম অলরেডি পৃথিবীতে হয়েই গেছে, তাহলে এখানে আবার অভিশাপের প্রয়োজন কী ? যে ব্যক্তি জেল খাটছে, তাকে আবার জেলের ভয় দেখিয়ে লাভ কী বা জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েই বা লাভ কী ? এই সব বিবেচনায়- উদ্ভট ও গাঁজাখুরি কাহিনী সমৃদ্ধ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রচয়িতা যে সুস্থ মস্তিষ্ক্যের মানুষ ছিলো না, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এমনই উদ্ভট আর অবান্তর কাহিনীর মাধ্যমে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম ও যৌনতাকে তুলে ধরা হয়েছে, যেটা চালানো হয়েছে মহাভারতের মতো বিশুদ্ধ গ্রন্থের রচয়িতা বেদব্যাসের নামে এবং রাধা ও কৃষ্ণের এই প্রেম নাকি নিষ্কাম এবং রাধা ও কৃষ্ণের এই লীলা নাকি অপার্থিব, অপ্রাকৃত ! আসলে এসব বলে শত শত বছর ধরে বৈষ্ণব গুরুরা এবং হরিবাসরে যারা লীলাকীর্তন পরিবেশন করে, তারা, হিন্দু সমাজকে এক বিশাল ধোকা দিয়ে যাচ্ছে, এখন সময় এসেছে সত্যকে গ্রহন করে মিথ্যাকে বিলুপ্ত করার; কারণ, মিথ্যাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্পর্কিত বাকি আলোচনা পাবেন, এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে।)

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।

No comments:

Post a Comment