১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গ থেকে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস : (পর্ব-২)
উদ্বাস্তু হিন্দুদের ভারতমুখী স্রোত :
১৯৪৮, ৪৯ সালে বিচ্ছিন্ন দু একটি ঘটনা, যা উপরে উল্লেখ করেছি, তা ঘটলেও ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে হিন্দুদের উপর শুরু হওয়া গণআক্রমন চলতে থাকে পুরো মাস জুড়ে। মুসলমানদের এই লুটেরা মানসিকতা দেখে এবং এই জংলীদের সাথে বসবাস করা যাবে না, এটা বুঝতে পেরে, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য হিন্দুদের দেশত্যাগের স্রোত শুরু হয়। সেই সময় পূর্ববঙ্গে - গোয়ালন্দ, পার্বতীপুর ও খুলনা, এই তিনটি জায়গা থেকে কোলকাতার ট্রেন পাওয়া যেতো। এজন্য- ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর জেলাসহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের লাখ লাখ হিন্দু, বাড়ি-ঘর, জমি-জমা সর্বস্ব ত্যাগ করে একবস্ত্রে দেশত্যাগের জন্য এসে জড়ো হতে শুরু করে গোয়ালন্দে; উত্তরাঞ্চলের হিন্দুরা পার্বতীপুরে এবং যশোর ও খুলনাসহ পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুরা খুলনা স্টেশনে। সীমান্তের আশে পাশের জেলার হিন্দুরা বাসে করে সড়ক পথে বা পায়ে হেঁটেই ঢুকে পড়ে ভারতে। বরিশাল থেকে কোলকাতা যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলো জলজাহাজ। তাই বরিশাল, পটুয়াখালি, ভোলা জেলার হিন্দুরা বরিশালে এত পরিমাণ এসে জড়ো হতে শুরু করে যে, জেটিতে স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
উদ্বাস্তু হিন্দুদের ত্রাণকর্তা মহাত্মা ডা. বিধান চন্দ্র রায় :
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দারা মূখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়কে এই ইনফরমেশন দেয় যে- বরিশাল, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, খুলনা প্রভৃতি রেলস্টেশন এবং স্টিমার ঘাটে লাখ লাখ হিন্দু একবস্ত্রে জড়ো হয়ে পশ্চিম বাংলায় আসার জন্য আর্তনাদ করছে। এই সংবাদ শোনার পর মহাত্মা ডা. বিধান চন্দ্র রায়, দুই ব্রিটিশ স্টিমার কোম্পানি - আরএসএন ও আইজিএন - এর কোলকাতা ও লন্ডনের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ডা. রায়ের অনুরোধে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ প্রায় ১ মাস ধরে প্রতিদিন কয়েকটি বিশেষ স্টিমার চালায় বরিশাল স্টিমার ঘাট থেকে কোলকাতার জগন্নাথ ঘাট পর্যন্ত। এভাবে সম্পূর্ণ খালি হাতে, এক কাপড়ে, বরিশাল থেকে প্রায় এক লাখ হিন্দু প্রায় ৩ দিনের সমুদ্র যাত্রা পেরিয়ে পৌঁছায় কোলকাতা। এই উদ্ধাস্তু হিন্দুদের নিয়ে স্টিমারগুলি যখন কোলকাতার জগন্নাথ ঘাটে "ম্যান অব ওয়্যার জেটি"তে নোঙর করতো, তখন কোলকাতার অপেক্ষমান আত্মীয় স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। এই প্যারাটা পড়তে গিয়ে আপনাদের কী অবস্থা হচ্ছে আমি জানি না, তবে এই প্যারাটা লিখতে গিয়ে, উদ্বাস্তু হিন্দুদের দুর্দশা এবং এই হিন্দুদের দুঃখ কষ্ট লাঘবের জন্য ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের তৎপরতা ও মহানুভবতা, কয়েকবার আমার চোখে জল এনে দিয়েছে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, রেল স্টেশন এবং স্টিমার ঘাট থেকে উদ্বাস্তু হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার তো একটা ব্যবস্থা হলো; কিন্তু ঢাকার হিন্দুদের এরকম কোনো ব্যবস্থা তখনও হয় নি। অন্যদিকে মুসলমানরা ঢাকায় মেরে চলেছে একের পর এক হিন্দু। হিন্দুরা প্রাণ ভয়ে জড়ো হতে শুরু করে এয়ারপোর্টে, যদি কোনো ভাবে বিমান যোগে কোলকাতা পৌঁছানো যায়, এই আশায়। মহাত্মা বিধানের কানে এই সংবাদ গোয়েন্দারা দিতেই তিনি এরও একটা সমাধান করে ফেলেন। ডা. বিধান ছিলেন, এয়ার ওয়েজ ইন্ডিয়া লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি, কেন্দ্র থেকে জওহর "বাল" নেহেরু কী নির্দেশ দেবে, সেই আশায় বসে না থেকে ঐ বিমান কোম্পানির কর্মকর্তা কে.কে রায়কে টেলিফোন করে বলেন, "যতখানি সম্ভব প্লেন ঢাকায় পাঠাও, আর যাদের আনবে, তাদের কাছ থেকে কোনো ভাড়া চাইবে না।" আবারও আমার চোখ ভরা জল নিয়ে বলছি, ডা. রায় এর নির্দেশ মতো ১৬ টি প্লেন ঢাকার অসহায় হিন্দুদের উদ্ধার করে পৌঁছায় কোলকাতায়। এর একটি বিমানেই ১৯৫০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অসহায় ও নিস্ব অবস্থায় এক বস্ত্রে কোলকাতা চলে আসতে বাধ্য হন, শ্রদ্ধেয় হিন্দু যোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ দত্ত; যার লেখনির মাধ্যমেই আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৬ ও ১৯৫০ সালের হিন্দু নির্যাতনের অনেক ঘটনা।
যা হোক, নিজের পকেট থেকে ডা. রায়, উদ্বাস্তু হিন্দুদের কোলকাতার পৌঁছানোর প্লেন, স্টিমার ভাড়া দিয়েছিলেন। সেই সময় বরিশাল থেকে কয়েকটি জাহাজ, কিছু হিন্দুকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে রেখে আসে। সেই থেকে তারা সেখানেই নির্বাসিত জীবন যাপন করছে। আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত নেহেরুর কৌশলে এই ঘটনাটি ঘটে। কেননা, উদ্বাস্তু হিন্দুদের জন্য যে লোকের এত দরদ, নিজের পকেটের টাকা খরচ করে যে লোক অসহায় হিন্দুদেরকে উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো, সেই লোক কিছু হিন্দুকে আন্দামানে নির্বাসনে পাঠাতে পারে না। এর পেছনে নিশ্চয় কেন্দ্র থেকে নেহেরুর চাপ বা ষড়যন্ত্র ছিলো। এ প্রসঙ্গে শেষের দিকে কিছু আলোচনা করেছি।
পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দুদেরকে পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তর করা প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় সরোজ চক্রবর্তী তাঁর "মূখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে" নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, "কিন্তু ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহ থেকে পূর্ববঙ্গ থেকে যে উদ্বাস্তু-জনস্রোত আসতে লাগলো, সংখ্যায় তা হলো বৃহত্তম। এই সংখ্যা পূর্বের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করলো। খুলনা জেলার নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক অত্যাচার হয়েছিলো, এবং তার ফলে নর-নারী ও শিশুদের এক বিশাল জনতা বনগাঁ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে এসে পড়লো। পাকিস্তান সরকার হিংসাত্মক ঘটনার খবর প্রথম দিকে একেবারে চেপে দিয়েছিলো। ডা. রায় সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী তার প্রত্যুত্তর করলেন। এ সব বাদ-বিসম্বাদ সত্ত্বেও হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ভয়াবহ কাহিনী চারদিকে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো। ১ লক্ষ ৩০ হাজার উদ্বাস্তু সীমান্তবর্তী নগর বনগাঁয় এসে হাজির হলো। রাজশাহী ও ঢাকাতে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু সব থেকে ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো বরিশালে। রেল স্টেশনে, স্টিমার ঘাটে, আর ঢাকা বিমানবন্দরে অসহায় উদ্বাস্তুর দল আটকা পড়ে রইলো। ডা. রায় এদেরকে ভারতে আনবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন।"
পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দু বনাম নির্বিকার নেহেরু এবং শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা :
সরকারী হিসেবে ১৯৫০ সালে পরিকল্পিতভাবে ৫০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়; বেসরকারী হিসেবে সংখ্যাটা কত হতে পারে তা একটু চিন্তা করুন; সেই সাথে কল্পনা করুন-ধর্ষণ-লুঠপাট ও অগ্নি সংযোগ কী পরিমাণ হয়েছে। এর সবই করা হয় বাকি হিন্দুদেরকে ভয় দেখিয়ে থেকে তাড়ানোর জন্য, যাতে হিন্দুদের জমি-জমা, বাড়ি-ঘর এমনিই দখল করা যায় বা নিদেনপক্ষে নাম মাত্র মূল্যে পাওয়া যায়। আর এই বিতাড়নে সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরও ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। কেননা, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বিষয়ে, মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে গেলে, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলো, আপনি এসব বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু ঘটনার সত্যতার বিষয়ে যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল জোর করলে, তাকে গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়। যোগেন্দ্র নাথ বুঝতে পারেন, পাকিস্তান নামক জঙ্গলে সভ্য লোকেদের কোনো স্থান নাই। এরপর তিনি কোলকাতায় চলে যান এবং কোলকাতা থেকেই ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে তার পদত্যাগ পত্র করাচীতে পাঠিয়ে দেন।
যা হোক, পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল মানুষদের মাধ্যমে এই সব পৈশাচিক হত্যালীলার সংবাদ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তেই দেশ জুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। ক্ষমতাসীন বহু মানুষকেও নাড়া দেয় এসব ঘটনা। দেশ থেকে হিন্দুদেরকে বিতাড়ন করার পাকিস্তানী এই নোংরা খেলাকে বন্ধ করার জন্য নেহেরুর সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করার পরামর্শ দেয় ড. শ্যামাপ্রসাদের মতো বুদ্ধিমান নেতারা। কিন্তু পরকীয়ায় পণ্ডিত নেহেরুর তাতে কোনো ভাবান্তর হয় না। সে "দেখা যায় কী হয়" এই নীতি নিয়ে চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে কালক্ষেপন করতে থাকে এবং অবশেষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সাথে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নেয়। এর ফলে ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল, এই দুইজনের মধ্যে একটা চুক্তি হয়, যেটা দিল্লি চুক্তি বা নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি নামে পরিচিত; এতে উদ্বাস্তুদের আবার তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়। এর ফলে যে দুচার জন মুসলমান ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলো, তারা আবার ভারতে চলে আসে; কিন্তু একজনও হিন্দুকে নেহেরু পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে নি। মানে এই চুক্তিরও লাভও তুলে মুসলমানরা।
শুরু থেকেই এই আলোচনায় বসা ও চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ; কারণ তিনি বুঝেছিলেন এর সবই হবে অর্থহীন, হয়েছিলোও তাই। উদ্বাস্তু সমস্য নিয়ে, এই ব্রেভহার্ট শ্যামাপ্রসাদের কথা নেহেরু না শোনায়- শ্যামাপ্রসাদ, নেহেরুকে ধমক দিয়ে, মন্ত্রীসভায় থাকলে হিন্দুদের জন্য কিছু করতে পারবেন না, এটা বুঝতে পেরে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে চলে আসেন ১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল।
ড. শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি করে যেমন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করে গিয়েছিলেন, (যদিও বাম ও মমতার মুসলিম তোষণ নীতির কারণে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের ভবিষ্যৎ বর্তমানে ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে,) তিনি পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের সুরক্ষার জন্যও প্রাণান্ত চেষ্টা করে গিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, "আমরা যেন ভুলে না যাই যে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা ভারতের সংরক্ষণ লাভের অধিকারী, শুধু মানবিকতার কারণেই নয়, বরং ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও বৌদ্ধিক প্রগতির ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য তারা বংশের পর বংশ ব্যাপী সানন্দে নিস্বার্থভাবে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার দরুনই আমাদের তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো কর্তব্য।"
উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে নেহেরু ও ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের মধ্যে বিরোধ :
১৯৫০ সালে এক ধাক্কায় ৫০ লাখ হিন্দুর মধ্যে ৩৫ লাখ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিলেও, এই শরণার্থীর স্রোত শুরু হয়েছিলো ১৯৪৬ সালের নোয়াখালি হিন্দু নিধন যজ্ঞের পর থেকেই। সরকারী হিসেব মতে ১৯৪৯ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীর সংখ্যা ১৬ লক্ষ, বেসরকারী মতে কত হতে পারে সেটা একটু ভেবে নিন। এই উদ্বাস্তু সমস্যার প্রতি নেহেরুর উদাসীনতা লক্ষ্য করে এক প্রকার বিরক্ত হয়েই ডা. বিধান নেহেরুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, "আপনার ধারণা, কেন্দ্র এই রাজ্যকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের খাতে বিপুল পরিমান অর্থ সাহায্য দিয়েছে। ১৯৪৮-৪৯ এবং ১৯৪৯-৫০ এই দুই বছরে কেন্দ্রীয় সরকার এই রাজ্যকে মাত্র ৩ কোটি টাকা দিয়েছে। ২ বছরে মাত্র ৩ কোটি।"
উত্তরে জহর (বিষ) লিখেছিলো, "আমি আগেও বলেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর মানুষ এপারে চলে এলেও সেই সমস্যার কোনো সমাধান নেই। আমি এখনও মনে করি, যেভাবেই হোক এই উদ্বাস্তুর স্রোত বন্ধ করা প্রয়োজন।" নেহেরু এই কথার সূত্র ধরেই আমার মনে হয়, ১৯৫০ সালে বরিশাল থেকে কোলকাতা গামী কয়েকটি জাহাজকে আন্দামান দ্বীপের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়; যদিও এ ব্যাপারে কোনো প্রামানিক তথ্য আমার হাতে নেই। কারণ, ডা.বিধান নেহেরুকে পাশ কাটিয়ে জাহাজের ব্যবস্থা করে বরিশালের হিন্দুদের কোলকাতায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো। কিছু লোক স্থানান্তরিত হওয়ার পর সম্ভবত নেহেরু বিষয়টি জানতে পারে এবং সে জাহাজের ক্যাপ্টেনদেরকে নির্দেশ দেয় আন্দামানে তাদের খালাস করার জন্য। ভারতে ব্যবসা করতে হলে বিধানের চেয়ে যে নেহেরুকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে, সেটা মনে হয় জাহাজ ব্যবসায়ীরা বুঝেছিলো। কারণ, হাজার হলেও বিধান মূখ্যমন্ত্রী আর নেহেরু প্রধান মন্ত্রী।
নেহেরুর সঙ্গে ডা. বিধানের মত বিরোধ কতটা ছিলো, আরেকটি চিঠির বক্তব্য থেকে তার কিছু টের পাওয়া যায়। ডা. বিধান পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান চেয়ে নেহেরুর কাছে চিঠি লিখলে, নেহেরু উত্তর দেয়, "পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা আসলে মানসিক।" এই লোক বাঙালি হিন্দুদের যে কী চোখে দেখতো, সেটা এবার বুঝে নিন।
এ প্রসঙ্গে আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখি। অনেকেই জানেন, ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের মূখ্যমন্ত্রীত্বের আমলে জ্যোতি বসু বাস-ট্রাম পুড়িয়েছিলো। ডা. বিধানকে বিপাকে ফেলে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য এই পরিকল্পনা ছিলো স্বয়ং নেহেরুর। উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে শুরু করে পরবর্তী আরো নানা বিষয় নিয়ে নেহেরু, বিধান রায়কে এতটাই অপছন্দ করতে শুরু করে যে, নিজের দল কংগ্রেসের মূখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নেহেরু বিধান রায়কে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করানোর জন্য জ্যোতিবসুর সাথে ষড়যন্ত্র করে এবং বলে, "আমি কেন্দ্র থেকে পেট্রোল ডিজেল এর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছি, তুমি পশ্চিমবঙ্গে এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করো।" এক কথায় বিধানকে বিপাকে ফেলে ক্ষমতা থেকে হটাও। এমনই নীতি কংগ্রেসের। নিজের দেশের ক্ষতি করতে যেমন এদের বাধে না, তেমনি নিজের দলেরও।
লুঠ-খুন-ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি :
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ২৯%। ফলে প্রাদেশিক সরকারেও হিন্দু কর্মচারী ছিলো ২৫ থেকে ২৯% এর মতো। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষায় হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়ে অগ্রসর হওয়ায় ডাক্তার, উকিল মোক্তারসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০ শতাংশ। এই অবস্থায় ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই এক ধাক্কায় প্রায় ৫০ লক্ষ হিন্দু দেশ ত্যাগ করে। যেসব হিন্দু তার পরেও দেশে থেকে গিয়েছিলো, মুসলমানরা, সেসব হিন্দু আইনজীবী-ডাক্তার-দোকানদারসহ ছোট বড় ব্যবসায়ীদের বয়কট করে, ফলে রুটি-রুজির তাগিদে অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। কী সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা একবার চিন্তা করুন ? কোরানের ৫/৬৪ আয়াতে বলা আছে,
"আমি তোমাদের মধ্যে ও ইহুদিদের মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত শত্রুতা সৃষ্টি করে দিয়েছি।"
এই আয়াত শুধু ইহুদিদের জন্য প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য পৃথিবীর সকল অমুসলমানদের জন্য। তাই একবার প্রাণে মেরে ভয় দেখিয়ে মুসলমানরা পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের তাড়ালো; পরে, তাদেরকে পেশাগত দিক থেকে বয়কট করে ভাতে মেরে তাড়ানোর ব্যবস্থা করলো। এছাড়াও কোনো আইন সংক্রান্ত বিধি ব্যবস্থা না নিয়ে গায়ের জোরে সরকার থেকে ব্যাপকহারে অবস্থা সম্পন্ন হিন্দুদের সম্পত্তি অধিগ্রহন করা হয়েছিলো, ফলে ওই হিন্দুরাও বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো, ফলে তারাও দেশ ছেড়ে চলে যায়। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ জারি করা হয়েছিলো, স্কুলের প্রতিটি কক্ষ-জিন্নাহ, ইকবাল, লিয়াকত নাজিমুদ্দীন এরকম ১২ জন বিশিষ্ট মুসলিম নেতাদের নামে নামাঙ্কিত করতে এবং প্রতিদিন স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে বাধ্যতামূলক কোরান পাঠে অংশ গ্রহন করতে; এই ধর্মীয় চাপে পড়েও অনেকে দেশ ছাড়ে। হিন্দু শিক্ষকদের ব্যাপকহারে দেশ ত্যাগের ফলে সেই সময় পূর্ববঙ্গের দেড়হাজার হাইস্কুলের মধ্যে ১ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দু ডাক্তাররা দেশ ত্যাগের ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। হিন্দু পুরোহিত ও মৃৎশিল্পীরা দেশ ত্যাগের ফলে হিন্দুদের পূজা অর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিক কিছুকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ইউনিয়ন বোর্ডগুলিতে যেখানে হিন্দু প্রেসিডেন্ট ছিলো, তাদের জোর করে সরিয়ে মুসলমানদের নিয়োগ করা হয়। আর সরকারী চাকুরিতে যে সব হিন্দু ছিলো, তাদের কাউকে কাউকে কোনো কারণ না দেখিয়েই বরখাস্ত করা হয় এবং কাউকে কাউকে ডিঙ্গিয়ে মুসলমানদের পদোন্নতি দেওয়া হয়, ফলে রাগে ক্ষোভে অভিমানে অনেক হিন্দুরাই সরকারী চাকরি ছেড়ে দেয়। হিন্দুদেরকে হত্যা এবং হিন্দু বাড়িতে চুরি ডাকাতির ঘটনা আগের মতোই চলছিলো; কিন্তু ধর্ষণ কমে এসেছিলো। কারণ, কোনো হিন্দু বাড়িতেই ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যের কোনো মেয়ে ছিলো না। সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। যেসব পরিবার হিন্দু মেয়েদেরকে ভারতে পাঠাতে পারে নি, তাদের পরিবারের মেয়েরা আগের মতোই ধর্ষিতা হচ্ছিলো। হাট-বাজারে ধান, পাট বা কোনো কৃষিপণ্য বিক্রি করতে নিয়ে গেলে মুসলমানরা তাদের ইচ্ছা মতো দাম দিতো, ন্যায্য মূল্য কখনোই দিতো না, এসব চাপে পড়েও হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করতে থাকে। মুসলমানদের এই মানসিকতার কারণ বুঝতে হলে দেখে নিন, কোরানের ৩৩/৬০ আয়াতটি
"পরে তোমাদের সাথে তাদের বসবাসই কঠিন হবে।"
১৯৫০ এর পর পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি :
পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হওয়া ৫০ লক্ষ হিন্দুর মধ্যে ৩৫ লক্ষ আশ্রয় নেয় পশ্চিমবঙ্গে, বাকিরা আসাম ও ত্রিপুরায়। এই উদ্বাস্তুদের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এক নতুন প্রজন্মের দেখা দেয়, যাদের জন্ম জন্ম রেল লাইনের পাশের কুঁড়ে ঘরে, এমনকি রেলগাড়ির পরিত্যক্ত কামরায়। শিয়ালদহ স্টেশনের ৭৫/৮০ মাইলের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ধুবুলিয়া, বাদকুল্লা, রূপশ্রী, কুপার্সক্যাম্প, তাহেরপুর, রাণাঘাট, গয়েশপুর, ঘোলা প্রভৃতি শরণার্থী শিবিরের যুবতী মেয়েদের দেখা যেতে লাগলো সন্ধ্যার পর ধর্মতলা, চৌরঙ্গী ও এসপ্ল্যানেডের মোড়ে। কোলকাতার পতিতালয়গুলিতে শোনা গেলো বাঙাল উচ্চারণে কথা বলা মেয়েদের। শুধু বেঁচে থাকার জন্য এবং ভাই-বোন ও বৃদ্ধ বাবা-মার পেট ভরানোর জন্য এই সব অসহায় হিন্দু মেয়েরা তাদের দেহ স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলো। উদ্বাস্তদের কারণেই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে ঘটে মানবিক বিপর্যয়। অথচ যার ভুল নীতির কারণে এই লক্ষ লক্ষ হিন্দুর দুর্দশা, সেই নেহেরু এদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো, "দেশ ভাগের লেজ ধরে অনেক শয়তান এখানে চলে এসেছে।" নির্বোধ এবং অযোগ্য লোক রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসলে দেশবাসীর যে কী অবস্থা হয়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নেহেরু।
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষের একজন লোক, এজন্য পরে তাকে পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় রাখা হয়। কিন্তু মুসলমানদের জংলী মানসিকতা দেখে এবং পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের দুর্দশা দেখে, এর প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং একই সাথে জংলী পাকিস্তানও ত্যাগ করেন। কোলকাতা থেকে করাচীতে, তিনি যে পদত্যাগ পত্র পাঠান সেই পত্র থেকেই ১৯৫০ এর হিন্দু বিতাড়ন সম্পর্কে বেশি তথ্য জানা গিয়েছে এবং সেই পদত্যাগ পত্রের শেষের দিকে তিনি কিছু কথা বলেছেন, সেগুলো মুসলমানদের মানসিকতাকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে এই লেখায় সেই চিঠিটি হুবহু উল্লেখ করছি-
"পাকিস্তানে হিন্দুদেরকে সবদিক থেকেই বিড়ম্বিত করে দেশের মধ্যেই রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে।...মুসলিম লীগ নেতারা বারবার বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন যে, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে জন্মগ্রহন করেছে এবং মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই বেড়ে উঠবে।...মহান শরিয়ত নির্দেশিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা শুধু মুসলমানদের হাতেই থাকবে। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যাঘুরা সেখানে হবে জিম্মি। এই সব জিম্মিরা রাষ্ট্রের কাছে থেকে তাদের নিরাপত্তা ও বাঁচার অধিকার পেতে কিছু মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে।"
"গভীর উৎকণ্ঠা এবং দীর্ঘদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, পাকিস্তান হিন্দুদের বসবাসের জায়গা নয়। সেখানে তাদের ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন; তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ধর্মান্তরিতকরণ অথবা নিশ্চিত অবলুপ্তির করাল গ্রাস। বিরাট সংখ্যক হিন্দু পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেছেন। যেসব হিন্দু এই অভিশপ্ত প্রদেশে থেকে যাবেন, ভাবতে কষ্ট হয়, তারা সবাই ক্রমে ক্রমে পরিকল্পিত পদ্ধতির যাঁতাকলে পড়ে হয় ধর্মান্তরিত হয়ে যাবেন, নয় তো খুন হয়ে যাবেন।"
"আমি যখন নিশ্চিত যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার মন্ত্রী পদে থাকা সত্ত্বেও সেখানকার হিন্দুদের কোনো কাজেই লাগতে পারবো না, তাদের জন্য কোনো সুযোগ সুবিধা ই আদায় করতে পারবো না; তখন সব জেনে শুনে পাকিস্তানের হিন্দুদের এবং বিদেশের মানুষের মনে এই ধারণা কেনো দিতে যাবো যে পাকিস্তানে হিন্দুরা পূর্ণ মান-মর্যাদা-নিরাপত্তা এবং সম্পত্তি ও নিজের ধর্মাচরণের অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারছে বা পারবে ? এরকম ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করার মতো ভণ্ডামি করা আমার উচিত নয় বলে মনে করছি এবং মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করছি।"
"আমি আপনাকে এবং আপনার সহকর্মীদের জানাতে চাই যে, হিন্দুদের যতই ভয় দেখানো হোক বা অন্য কোনো ভাবে তাদের উত্তেজিত করা হোক, তারা তাদের জন্মভূমিতে জিম্মি হতে যাবে না। আজ তারা তাদের পূর্বসূরীদের অনুসরণ করে নিজেদের জন্মভিটা ত্যাগ করছে বটে; কিন্তু আগামী দিনে তারা নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করে নিতে এগিয়ে আসবে।"
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের এই কথার সূত্র ধরে বলছি, এই ন্যায্য পাওনা আদায় করার সময় এখন চলে এসেছে। কারণ, হিন্দুরা মুসলমানদের অনেক দিয়েছে, রক্ত - মেয়েদের শরীর - জীবন - ধন সম্পদ - জন্মভিটা - জমিজমা - সব; আর কিছুই দেবে না। এখন নেবে, এমনি না দিলে জোর করে, কৌশলে ছিনিয়ে নেবে এবং নেবো।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম। জয় শ্রীকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment