"আমরা সনাতনী" গ্রুপের মডারেটর Tusar Sarker গত ১৯.৮.১৮ তারিখে "শ্রী কৃষ্ণ ছাড়াও সনাতন শাস্ত্র অনুযায়ী যারা বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন" নামে একটি পোস্ট করে এটা প্রমান করার চেষ্টা করেছে যে, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে বিশ্বরূপ প্রদর্শন কোনো ঘটনা নয়, একজন মুনিও কাউকে অমন বিশ্বরূপ দেখাতে পারে।
তার এই পোস্টের উদ্দেশ্য যে শ্রীকৃষ্ণকে ছোট করা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তুষার সরকার, তার বিশ্বরূপের রেফারেন্স হিসেবে- কূর্ম পুরান, বৃহৎ সংহিতা, গনেশ গীতা, চণ্ডী, বরাহ পুরান, বায়ু পুরান, বামন পুরান, পদ্ম পুরান, লিঙ্গ পুরানের নাম উল্লেখ করেছে; কিন্তু তুষার সরকারের সম্ভবত জানা নেই যে গীতার ৭০০ শ্লোক ছাড়া হিন্দু ধর্মের সমস্ত গ্রন্থ কোনো না কোনো ভাবে বিকৃত, পুরানগুলো তো বিকৃতির মহারাজা; তাই কোনো সিদ্ধান্ত পুরানের রেফারেন্সের উপর নেওয়া উচিত নয়, আর তা সঠিকও নয়। গীতার ৭০০ শ্লোকের বাইরে কোনো রেফারেন্স দিতে হলে আগে পিছে বহু চিন্তা করে, ঘটনা পর্যায় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তারপর তা বলতে বা দিতে হবে, না হলে সেই রেফারেন্স যে অন্তঃসার শুন্য বা মিথ্যা প্রমানিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শ্রীকৃষ্ণ কী এবং তিনি কে, এই বিষয়টি ভালো মতো জানা থাকলে সম্ভবত তুষার এই পোস্ট লিখতো না; এ প্রসঙ্গে পরে আসছি, আগে বলে নিই বেদব্যাসকৃত পুরানগুলো কিভাবে বিকৃত হয়েছে।
বেদব্যাসের হাতে- বেদ, মহাভারতসহ পুরাণগুলো লিপিবদ্ধ হওয়ার পর, বিভিন্ন ব্যক্তির প্রয়োজনে সেগুলো কপি হতে শুরু করে। তথন তো আর ছাপাখানা ছিলো না, তাই গ্রন্থগুলো কপি হতো হাতে লিখে, যাদের হাতের লেখা ভালো ছিলো তারা এই কাজ পেতো এবং এদেরকে বলা হতো লিপিকার। কোনো এক ব্যক্তি, হয়তো তার নিজের প্রয়োজনে বেদব্যাসের নিকট থেকে মূল পাণ্ডুলিপি নিয়ে কোনো এক লিপিকরকে দিয়েছে কপি করার জন্য, সেই লিপিকর যখন সেটা কপি করেছে, তখন তার মধ্যে নিজের মেধা ও বুদ্ধিমতো কিছু সংযোজন বিয়োজন করে ছেড়ে দিয়েছে। লিপিকারদের এই কারসাজিকে বুঝতে না পেরে এই বিকৃত পাণ্ডুলিপিকেই পাণ্ডুলিপির নতুন মালিক সঠিক বলে জেনেছে এবং সেই পাণ্ডুলিপি হতে যখন নতুন আরেকটি পাণ্ডুলিপি হয়েছে, তখন তাতেও লিপিকাররা সেই একই ঘটনা ঘটিয়েছে। সব লিপকিার যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা বলছি না, তবে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন লিপিকার এই ঘটনা যে ঘটিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কারণ, মানুষ হচ্ছে অত্যন্ত ধান্ধাবাজ এবং কতৃত্বপরায়ণ প্রাণী। কোথাও কোনো ক্ষমতা খাটানোর সুযোগ থাকলে মানুষ তা খাটাবেই।
কপি করার সময় সংযোজন বিয়োজন করে বড় বড় গ্রন্থের মধ্যে বিকৃতি ঘটানো তো খূব সহজ ব্যাপার, যেখানে সেই সুযোগ নেই, কাব্যপ্রতিভাসম্পন্ন অখ্যাত মানুষেরা সেখানেও কিছু করার চেষ্টা করেছে এই কামনায় যে, তবু যেন তাদের কিছু লেখা মানুষ পড়ে; যেমন- মধ্যযুগে চণ্ডীদাস ছিলো বৈষ্ণব পদাবলীর একজন বিখ্যাত কবি, তার নাম নকল করে বহু কবি বৈষ্ণব পদাবলী লিখেছে, এই আশায় যে চণ্ডীদাস নাম দেখলেও কিছু লোকে তার কবিতা পড়বে। এই চণ্ডীদাস সমস্যা বাংলা সাহিত্যের একটি বিশাল সমস্যা, প্রকৃতপক্ষে চণ্ডীদাস কয়জন বা প্রকৃত চণ্ডীদাস কে, তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের এক বিশাল গবেষণা চালাতে হয়। জানলে অবাকও হতে পারেন যে, প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিজের নামে না চালিয়ে "ভানুসিংহ" নামের ছদ্মবেশে 'ভানুসিংহের পদাবলী' নামে এক ধরণের বৈষ্ণব কবিতা লিখে তাদের পারিবারিক পত্রিকায় ছাপাতেন, এই আশঙ্কায় যে রবীন্দ্রনাথ নাম দেখলে কেউ তার কবিতা পড়বে না, তার পরিবর্তে 'ভানুসিংহ' নাম দেখলে, এটা মধ্যযুগের কোনো কবি ভেবে তার কবিতা কেউ পড়লেও পড়তেও পারে।
লেখকদের এই চিরন্তন আকুতি, তার লেখা সবাই পড়ুক, তাতে তার নিজের নাম থাক বা না থাক। বাংলা ফেসবুক জগতে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম নিয়ে যত লেখা আছে, তার ৭৫% লেখা আমার নিজের, কপি করে কেউ সেগুলো নিজের নামে চালায়, কেউ আমার কাছে ঋণ স্বীকার করে, যে যেভাবেই চালাক ফেসবুকের পাতায় আমার লেখা নজরে পড়লেই এক ধরণের সুখ লাগে যে লোকজন আমার লেখা পড়ছে, পছন্দ করছে। কেউ যদি একান্তই আমার লেখা তার নিজের নামে না চালায়, আমি তার প্রতি খুব একটা রুষ্ট হই না।
যা হোক, লিপিকররা তাদের নিজের কথা অন্যদেরক পড়ানোর জন্য নানাভাবে হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলোতে বিকৃত করেছে এবং এই বিকৃতি চলেছে প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে, সুতরাং পুরানগুলো প্রকৃত অবস্থা কী, সেটা একবার কল্পনা করুন, আর ভাবুন, সেই পুরানগুলোর কোনো তথ্য বিনা সংকোচে বিশ্বাস বা গ্রহন করা সম্ভব কি না। পুরানগুলো যে নানাভাবে বিকৃত তার একটা বাস্তব উদহারন দিচ্ছি, তাতে কোনো পুরান না পড়েও আপনি এগুলোর বিকৃতিটাকে ধরতে পারবেন, শিব কর্তুক গনেশের মাথা কাটার ঘটনা আপনি যতগুলো পুরানে পাবেন, দেখবেন ততগুলোই ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে ভরপুর, তাহলে কোনটা সত্য? সত্য সব সময় একটাই হয়, মিথ্যারই বহু রূপ থাকে, পুরানের গল্পগুলোর বহুরূপই প্রমাণ করে যে, পুরানের গল্পগুলি নানা ভাবে বিকৃত।
১৮০০ সালের পর ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পুরানগুলো নানা ভাবে বিকৃত হয়েছে, সুতরাং পুরানগুলোর কোনো রেফারেন্স বিনা প্রশ্নে মেনে নেওযা সম্ভব নয়, আর সেই পুরানের রেফারেন্সের উপর ভিত্তি করে তুষার সরকার, বিশ্বরূপ প্রসঙ্গে কৃষ্ণকে ছোট করার অপপ্রয়াস করছে, আসলে এর পেছনে তুষার সরকারের উদ্দেশ্যটা কী ?
এবার আসি কৃষ্ণ- কী এবং কে সেই প্রসঙ্গে।
দেব-দেবীদের প্রকৃত পরিচয় এবং অবতার তত্ত্বের রহস্য লোকজন সঠিকভাবে জানে না বলেই তারা নানাভাবে নানাভাগে বিভক্ত এবং একেকজন একেক দেব-দেবীর ভক্ত বা অনুসারী। অথচ গীতার মধ্যেই স্পষ্ট করে বলা আছে যে, সমস্ত দেব-দেবীর অবস্থান শ্রীকৃষ্ণে এবং শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি ছাড়া কোনো দেব-দেবী তার ভক্তদের জন্য কিছু করতে পারে না।
দেখুন নিচের দুটি শ্লোক-
"যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম।।" - (গীতা, ৯/২৩)
এর অর্থ- হে কৌন্তেয়, যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধি পূর্বক আমারই পূজা করে
এবং
"স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হিতান্।"- ৭/২২
এর অর্থ: সেই পুরুষ শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেব বিগ্রহের পূজায় তৎপর হন এবং সেই দেবতার মাধ্যমে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্য লাভ করেন।
তার মানে দেব-দেবীরা যা করছে, তা কৃষ্ণের অনুমতি এবং ক্ষমতার বলেই করছে, এখন সেই দেব-দেবী যদি কাউকে কোনো ঘটনাক্রমে বিশ্বরূপ দেখিয়েই থাকে, তাতে সমস্যা কী ? তারা তো আর নিজের ক্ষমতা বলে কিছু করছে না, যা করছে তা কৃষ্ণের অনুমতি এবং ক্ষমতার বলেই করছে।
উপরে যা বলেছি, তাতেই তুষার সরকারের পোস্টের জবাব দেওয়া হয়ে গেছে, তারপরও তুষারের রেফারেন্সগুলোকে একটি একটি করে বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি যে, যারা যারা যারা বিশ্বরূপ দেখিয়েছে, তারা আসলে কে ?
তুষার তার প্রথম রেফারেন্সে বলেছে,
"দক্ষের কন্যা সতী জন্মের পরেই দক্ষকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন"
দক্ষ ও সতীর ঘটনা বাস্তব পৃথিবীতে কখনো ঘটে নি, বিশ্বসৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য সমস্ত দেব-দেবীর মতো দক্ষ এবং সতীও মুনি ঋষিদের কল্পনা। এই সতী মহাদেবের নারী শক্তি হিসেবে কল্পিত, অর্থাৎ সতীও যা মহাদেবও তাই, আর মহাদেবই যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, সে কথা বলা আছে গীতার নিচের এই শ্লোকে-
“রুদ্রানাং শঙ্করশ্চাস্মি”- (গীতা, ১০/২৩)
এর অর্থ : রূদ্রদের মধ্যে আমি শিব।
সুতরাং সতীর বিশ্বরূপ দেখানো শ্রীকৃষ্ণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো কিছু নয়।
দেব-দেবীদেরকে কাল্পনিক বলায় যাদের মাথার চান্দি গরম হয়ে গেছে, তাদের জন্য বলছি- কোনো কিছু কাল্পনিক মানেই তা অস্তিত্বহীন বা শক্তিহীন নয়। সব সময় বাস্তবের আগেই সৃষ্টি হয় কল্পনা এবং কল্পনা থেকেই বাস্তবের সৃষ্টি। পৃথিবীতে যা কিছু মানুষ তৈরি করেছে, তার সমস্ত কিছু আগে মানুষ তার কল্পনায় সৃষ্টি করেছে, পরে তা বাস্তব রূপ লাভ করেছে। বিষয়টা আরেকটু ক্লিয়ার করে দিচ্ছি-
গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময়ই আমরা এক্স, ওয়াই জেডকে ধরে নিই, এই XYZ কিন্তু পুরোটাই কল্পনা; কিন্তু অঙ্কের শেষে আমরা এগুলোর কিছু মান পাই, যা XYZ এর শক্তি এবং ঐ অঙ্কের ভিত্তি; একইভাবে বিশ্বসৃষ্টির গানিতিক রহস্যকে সমাধান করার জন্য মুনি ঋষিদের কল্পিত বিভিন্ন দেব-দেবীও প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি এবং বিশ্বসৃষ্টির ভিত্তি।
যা হোক, তুষার তার দ্বিতীয় রেফারেন্সে বলেছে,
"বৃহৎ সংহিতায় ইন্দ্রের বিশ্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে"
কিন্তু ইন্দ্রই যে শ্রীকৃষ্ণ, তা বলা আছে, গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২২ নং শ্লোকে, সেখানে বলা আছে,
"দেবানামস্মি বাসবঃ"
এর অর্থ- সমস্ত দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্র।
এখানে বাসব মানে ইন্দ্র।
সুতরাং ইন্দ্র বিশ্বরূপ দেখালে তাতে সমস্যা কী ?
তুষার তার তৃতীয় রেফারেন্স বলেছে,
"গণেশ রাজা বরেণ্যকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন"
শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের ছবি ভালো করে দেখলে দেখবেন, তার মধ্যে গণেশের ছবিও আছে, তার মানে গণেশই শ্রীকৃষ্ণ; সুতরাং গণেশ বিশ্বরূপ দেখাতেই পারে, কোনো সমস্যা নেই।
৪র্থ এবং ৫ম রেফারেন্সে তুষার বলেছে,
"ব্রহ্মা চন্ডিকে স্তুতি করে বলছেনঃ
-হে দেবী, তুমিই সবকিছু ধারণ কর, তুমি জগৎ সৃষ্টি কর, তুমিই পালন কর, তুমিই প্রলকালে গ্রাস কর। (চণ্ডীঃ ১/৬৮-৬৯)
- এই জগতে আমি একাই, আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কে আছে? এই দুষ্ট দেখো- আমার বিভূতি আমাতেই প্রবেশ করছে। (চণ্ডী - ১০/৮)
এই চণ্ডী হলো দেবী পার্বতীরই এক রূপ, আর পার্বতী হলো শিব বা মহাদেবের নারী শক্তি, তার মানে পার্বতীই হলো চণ্ডী এবং চণ্ডী ই হলো মহাদেব বা শিব; আর শিব ই যে কৃষ্ণ সেটা তো গীতার ১০/২৩ নং শ্লোকে-“রুদ্রানাং শঙ্করশ্চাস্মি”- এর মধ্যেই বলা আছে, সুতরাং দেবী চণ্ডীরও বিশ্বরূপ দেখাতে তো কোনো সমস্যা নেই।
এই একই কথা প্রযোজ্য তুষারের ৫ম, ষষ্ঠ, ও ৭ম রেফারেন্সে যেখানে শিবের বিশ্বরূপের কথা বলা হয়েছে।
অষ্টম রেফারেন্সে তুষার ব্রহ্মার বিশ্বরূপের কথা বলতে গিয়ে বলেছে,
>> পদ্মপুরাণে ব্রহ্মার বিশ্বরূপের বর্ণনাঃ
- হে বিভু, আমি দেখছি তোমার অনেক মুখ, তুমি যজ্ঞের গতি, তুমি পুরাণ পুরুষ, তুমি ব্রহ্মা, ঈশ, জগৎসমূহের সৃষ্টিকর্তা। প্রপিতামহ, তোমাকে নমস্কার।
(পদ্মপুরাণ সৃষ্টি খণ্ডঃ ৩৪/১০০)
শিব যেমন কৃষ্ণ, তেমনি ব্রহ্মাও যে কৃষ্ণই সে কথা বলা আছে গীতার ১১/১৫ নং শ্লোকে, সেখানে বলা আছে-
"পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহেসর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্ ।"
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনন্থম্ ঋষীংশ্চ সর্বানুরাগাংশ্চ দিব্যান্।।- (গীতা, ১১/১৫)
এর অর্থ: হে দেব, আপনার দেহে আমি সমস্ত দেবতা, বিবিধ প্রাণীদের, পদ্মের আসনে অবস্থিত ব্রহ্মা, মহাদেব, সমস্ত ঋষিগণ এবং দিব্যসর্পসমূহ দেখছি।
সুতরাং ব্রহ্মা যদি কাউকে বিশ্বরূপ দেখায়, সেটা কৃষ্ণই দেখিয়েছেন এবং এতে সনাতন ধর্মের মূল থিয়োরির কোনো ব্রেক হয় নি।
তুষার তার নবম রেফারেন্সে আবার গণেশের কথা বলেছে, গণেশ বিষয়ে উপরে একবার বলেছি, তাই আর তার পুনরু্ল্লেখ করলাম না।
দশম রেফারেন্সে তুষার কার্তিকের বিশ্বরূপের কথা বলেছে, কিন্তু কার্তিকই যে শ্রীকৃষ্ণ, সে কথা মনে হয় তুষার জানে না, দেখে নিন নিচের শ্লোক-
“সেনানীনামহং স্কন্দঃ”- (গীতা, ১০/২৪)
এর অর্থ- সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিক।
সুতরাং কার্তিকের বিশ্বরূপ দেখাতে সমস্যা কোথায় ?
একাদশ রেফারেন্সে তুষার নারায়ণের বিশ্বরূপের কথা বলতে গিয়ে বলেছে,
"অনন্তর হরি মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেন। মুনিবর ভগবান দধিচী নারায়ন শরীর মধ্যে পৃথক পৃথক দেবতা, কোটি কোটি রুদ্র এবং কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড অবলোকন করলেন।" (৫৮;৫৯)
নারায়ণ ই যে কৃষ্ণ, সেটা তো সবাই কম বেশি জানে, সুতরাং নারায়ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এর পর তুষার দধীচি মুনির বিশ্বরূপের কথা বলতে গিয়ে বলেছে-
অতঃপর দধীচি মুনি মুনি বললেন -
- হে মহাবাহো! বিচারপূর্বক প্রতিভা দ্বারা মায়া ত্যাগ করুন, হে মাধব! বিজ্ঞানসহস্র নিতান্ত দূর্বিজ্ঞেয়। হে অনিন্দিত! আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দান করিতেছি, তুমি আমার শরীর মধ্যে তোমা সহ সমস্ত জগৎ ব্রহ্মা, রুদ্র এই সকল অবলোকন করো। (৬২;৬৩)
শ্লোকগুলোতে দধীচি মুনি বিশ্বরূপ কে মায়ার সাথে তুলোনা করেছেন এমনকি তিনি নিজেও বিষ্ণুকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। অতঃএব বিশ্বরূপ প্রদর্শন একজন মুনির পক্ষেও সম্ভব।
এখানে খেয়াল করুন, দধীচি মুনি দিব্যদৃষ্টি দান করছে নারায়ণকে, এই পুরান লেখক হয়তো খেয়াল করে নি যে, তার বক্তব্যে- সৃষ্টি, তার স্রষ্টার চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে; সকল পুরান যে ভয়াবহরকমভাবে বিকৃত এই ঘটনাটি তার আরেকটি প্রমান, সৃষ্টি কখনো তার স্রষ্টার চেয়ে বড় হতে পারে না, কিন্তু এখানে সৃষ্টি (দধীচি মুনি), স্রষ্টার (নারায়ণ) চেয়ে বড়! এই পুরানের রেফারেন্স দিয়ে তুষার বলেছে বিশ্বরূপ একজন মুনির পক্ষেও দেখানো সম্ভব এবং এই কথা বলে সে কৃষ্ণকে ছোট করার চেষ্টা করেছে, আমি তুষারকে জিজ্ঞেস করছি, আপনি কৃষ্ণকে ছোট করে কাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, বা আপনার প্রকৃত উদ্দেশ্যটা কী ?
এখন দেখা যাক দধীচি মুনি কে এবং তিনি কৃষ্ণের শক্তির বাইরে কি না ?
লিঙ্গ পুরানের রেফারেন্সে তুষার দধীচি মুনি কর্তৃক নারায়নকে দিব্যদৃষ্টি দানের কথা বলেছে, হিন্দু শাস্ত্রের ইতিহাসে এই দিব্যদৃষ্টি দানের মাত্র দুটি ঘটনা আছে, প্রথমটা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে দৃষ্টি দান, যার মাধ্যমে ধৃতরাষ্ট্র কিছুক্ষণের জন্য হলেও শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেয়েছিলো; দ্বিতীয় ঘটনাটি বেদব্যাস কর্তৃক ধৃতরাষ্ট্রের অনুচর সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি দান, যার মাধ্যমে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত না থেকেও যুদ্ধের ঘটনা দেখে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করেছিলো। এই দিব্যদৃষ্টি দানের ক্ষমতা দধীচি মুনির ছিলো, তার মানে দধীচি মুনির বিশেষ ক্ষমতা ছিলো; এছাড়াও আমরা জানি সব মুনি ঋষিরা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ এবং মুনি ও ঋষি প্রায় সমার্থক শব্দ। এখন দেখা যাক এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ গীতায় কিছু বলেছেন কি না ?
গীতার ১০ম অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোকের অর্থ হলো- এই পৃথিবীতে যা কিছু ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন অথবা শক্তিসম্পন্ন দেখবে, তা ই আমার শক্তির অংশ হতে উদ্ভূত বলে জানবে।
তার মানে দধীচি মুনির বিশ্বরূপ দেখানোর শক্তি শ্রীকৃষ্ণের নিয়ন্ত্রণ বা তার শক্তির বাইরে কিছু নয়, তাহলে দধীচি মুনির বিশ্বরূপ দেখানোতে প্রব্লেমটা কোথায় ?
এছাড়াও একটু আগেই বলেছি মুনি ও ঋষি প্রায় সমার্থক শব্দ, এখন ঋষিদের সম্পর্কে গীতায় কী বলা আছে সেটা দেখা যাক-
গীতার একাদশতম অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে অর্জুন বলেছেন, "হে প্রভু, আমি তোমার দেহের মধ্যে সমস্ত দেবতা, নানাবিধ প্রাণী, পুন্যাত্মা ঋষিবৃন্দ, সর্পকূল এবং কমলসানস্থ ব্রহ্মাকে দেখছি।"
এখন মুনি ও ঋষি যদি একই ধরণের ব্যক্তি হন, তাহলে দধীচি মুনির অবস্থান শ্রীকৃষ্ণে এবং এই দধীচি মুনি যদি বিশ্বরূপ দেখানই, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে ?
আবার মুনি ও ঋষি যদি আলাদা ধরণের ব্যক্তিও হন, তাহলে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু বলেছেন যে মুনীদের আমি ব্যাস (গীতা, ১০/৩৭) এবং "সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে আমি কপিল মুনি" (গীতা, ১০/২৬), আবার যেহেতু গীতার ১০ম অধ্যায়ের ৪০ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, " আমার বিভূতিসমূহের শেষ নেই, আমার যা কিছু বিভূতির কথা তোমাকে বললাম, তা আমার বিভূতিসমূহের সংক্ষেপ মাত্র।" তার মানে একজন ঋষির কথা বললেও শ্রীকৃষ্ণ সকল ঋষির কথা বলেছেন এবং একজন মুনির কথা বললেও সকল মুনির কথা বলেছেন এবং যেহেতু গীতার ১০ম অধ্যায়ের ৩৯ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, এই বিশ্ব চরাচরের কোনো কিছুই আমা ছাড়া হইতে পারে না" সেহেতু এটা পরিষ্কার যে দধীচি মুনিও শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ নয়, তাহলে সেই দধীচি মুনির বিশ্বরূপ দেখাতে দোষ কোথায় ?
উপরের এই সকল আলোচনা শেষে এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, একজন মুনিও বিশ্বরূপ দেখাতে পারে বলে তুষার সরকার শ্রীকৃষ্ণকে যে অবজ্ঞা করেছে, এটা গীতা সম্পর্কে তার অজ্ঞতা এবং শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং কে ও কী, তা না জানার অর্থাৎ তার মূর্খতারই ফল।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
নিচে দেখে নিন তুষার সরকারের পুরো স্ট্যাটাসটি।
একাএকাএএশ্রী কৃষ্ণ ছাড়াও সনাতন শাস্ত্র অনুযায়ী যারা বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন-
>> দক্ষের কন্যা সতী জন্মের পরেই দক্ষকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেনঃ
(কূর্মপুরাণ, পূর্বভাগঃ ১২/৫২-৫৩,৫৮)
>> বৃহৎ সংহিতায় ইন্দ্রের বিশ্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছেঃ
(বৃহৎ সংহিতাঃ ৪৩/৫৪-৫৫)
>> গণেশ রাজা বরেণ্যকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেনঃ
(গণেশ গীতাঃ ৮/৬-৭)
>> ব্রহ্মা চন্ডিকে স্তুতি করে বলছেনঃ
-হে দেবী, তুমিই সবকিছু ধারণ কর, তুমি জগৎ সৃষ্টি কর, তুমিই পালন কর, তুমিই প্রলকালে গ্রাস কর।
(চণ্ডীঃ ১/৬৮-৬৯)
- এই জগতে আমি একাই, আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কে আছে? এই দুষ্ট দেখো- আমার বিভূতি আমাতেই প্রবেশ করছে।
(চণ্ডী - ১০/৮)
>>বরাহ পুরাণে শিবের বিশ্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছেঃ
- শিব এখানে প্রোদেশ প্রমাণমাত্র হয়েও শতশীর্ষ, শত উদর বিশিষ্, সহস্র বাহু, সহস্র পদ, সহস্র চক্ষু, সহস্র মস্তক ও সহস্র মুখ সমন্বিত। অণু থেকে ক্ষুদ্র হয়েও সর্ববৃহৎ।
(বরাহ পুরাণ - ১/৯/৬৮)
>> বায়ু পুরাণেও শিবের বিশ্বমূর্তি বর্ণিত হয়েছেঃ
- শিবের উৎপত্তি অব্যাক্ত, তার দেহ ব্যাক্ত অর্থাৎ প্রকাশিত। তার দেহের অন্তর্গতসমূহ কাল। অগ্নি তাঁর মুখ, চন্দ্র ও সূর্য তার নেত্রদ্বয়, দিকসমূহ তাঁর কর্ণ, বায়ু তার ঘ্রাণ, বেদ তার বাক্য, অন্তরীক্ষ শরীর, পৃথিবী পদদ্বয়, তারকাগণ রোমকূপ।
(বায়ু পুরাণঃ ১/৯/৬৮)
>> বামন পূরাণেও শিবের বিশ্বরূপ পাওয়া যায়ঃ
- তুমিই বিষ্ণু, তুমিই ব্রহ্মা, তুমিই মৃত্যু, তুমিই বরদ, তুমি সূর্য ও চন্দ্র, তুমি ভূমি, তুমি জল, তুমি যজ্ঞ, নিয়ম, তুমি অতীত, ভবিষ্যৎ, তুমি আদি ও অন্ত, তুমি সূক্ষ্ম ও স্থুল, তুমিই (বিরাট) পুরুষ।
(বামন পুরাণঃ ৫৪/৯৬-৯৯)
>> পদ্মপুরাণে ব্রহ্মার বিশ্বরূপের বর্ণনাঃ
- হে বিভু, আমি দেখছি তোমার অনেক মুখ, তুমি যজ্ঞের গতি, তুমি পুরাণ পুরুষ, তুমি ব্রহ্মা, ঈশ, জগৎসমূহের সৃষ্টিকর্তা। প্রপিতামহ, তোমাকে নমস্কার।
(পদ্মপুরাণ সৃষ্টি খণ্ডঃ ৩৪/১০০)
>> গণেশ গীতাতে গণেশকে ব্রহ্মস্বরূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গণেশ নিজের স্বরূপ বর্ণনা করছেন এভাবে:
- হে রাজন। শিব, বিষ্ণু, শক্তি এবং সূর্যে যে ভেদবুদ্ধি সে আমারই সৃষ্টি, যেহেতু আমিই জগৎ সৃষ্টি করি, হে প্রিয়। আমিই মহা বিষ্ণু, আমিই সদাশিব, আমিই মহাশক্তি, আমিই অর্যমা।
(গণেশ গীতাঃ ১/২০-২২)
>> মহাভারতের মার্কেণ্ডেয়-কৃত কার্তিকেয় স্তবে কার্তিকেয়ে বিশ্বমূর্তিরূপে বন্দিত হয়েছেনঃ
- তুমি পদ্মপলাশলোচন, তুমি অরবিন্দতুল্যমুখ-বিশিষ্ট, তোমার সহস্র বদন,সহস্র বাহু, তুমি লোকপাল, শ্রেষ্ঠ হরি, সকল দেব ও অসুরগণের আবাধ্য।
( মহাভাঃ বনপর্বঃ ২৩১, অঃ৪৩)
>> লিঙ্গপুরাণ পূর্বভাগের ৩৬ তম অধ্যায়ে এরকম বর্ননা এসেছে। শ্রীবিষ্ণু ব্রাহ্মণবেশে দধীচি মুনির নিকট এসে বললেন - আমি আপনার নিকট বর প্রার্থনা করি আমাকে বর প্রদান করুন। দধীচি মুনি বললেন রুদ্রদেবের অনুগ্রহে ভূত ভবিষ্যত আমি জানি। আপনাকে আমি চিনিতে পারিয়াছি আপনি স্বরূপে ফিরে আসুন। আপনি কৃপা করে বলুন শিব আরাধনা পরায়ন ব্যক্তির কোন ভীতি থাকে? আমি কাহারও সমীপে ভয় পাই না। তখন বিষ্ণু ছদ্মবেশ ত্যাগ করে বললেন - হে বিপ্র আমি জানি তুমি কাহারো নিকট ভয় পাও না তবুও তুমি সভামধ্যে ক্ষুপভূপতিকে বলো আমি ভয় পাইতেছি। তখন মহামুনি বললেন আমি ভয় পাই না। তখন বিষ্ণু ক্ষুব্ধ হইয়া মহামুনিকে চক্র উত্তোলন করে মারতে উদ্যত হলেন। তখন মুনির সহিত ভয়ানক যুদ্ধ বাধলো। অতপর বিষ্ণু মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেনঃ
- অনন্তর হরি মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেন। মুনিবর ভগবান দধিচী নারায়ন শরীর মধ্যে পৃথক পৃথক দেবতা, কোটি কোটি রুদ্র এবং কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড অবলোকন করলেন।
(৫৮;৫৯)
অতঃপর দধীচি মুনি মুনি বললেন -
- হে মহাবাহো! বিচারপূর্বক প্রতিভা দ্বারা মায়া ত্যাগ করুন, হে মাধব! বিজ্ঞানসহস্র নিতান্ত দূর্বিজ্ঞেয়। হে অনিন্দিত! আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দান করিতেছি, তুমি আমার শরীর মধ্যে তোমা সহ সমস্ত জগৎ ব্রহ্মা, রুদ্র এই সকল অবলোকন করো। (৬২;৬৩)
শ্লোকগুলোতে দধীচি মুনি বিশ্বরূপ কে মায়ার সাথে তুলোনা করেছেন এমনকি তিনি নিজেও বিষ্ণুকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। অতঃএব বিশ্বরূপ প্রদর্শন একজন মুনির পক্ষেও সম্ভব।
No comments:
Post a Comment